বাড়ছে রেমিট্যান্স, কমছে ডলার সংকট

ডিসেম্বরের মধ্যেই বড় ধরনের সুখবর পাওয়া যাবে

সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নানা উদ্যোগে বাড়ছে রেমিট্যান্স এবং কমছে আমদানি ব্যয়। ফলে ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে ডলারের সংকট।

দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়েই চলেছে। জুলাই মাসের পর আগস্টেও রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের গতি বেশ ঊর্ধ্বমুখী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে ১৭২ কোটি ৯৩ লাখ (১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাঙালীরা। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। যদিও ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক রেটের চেয়ে এখনো অনেক বেশি টাকা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১০৫/১০৬ টাকা দরেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। সে হিসাবে কোনো প্রবাসী এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে ১ ডলার দেশে পাঠালে ১০৬ টাকার সঙ্গে নগদ প্রণোদনার ২ টাকা ৫০ পয়সা যুক্ত হয়ে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন। সে হিসাব বিবেচনায় নিলে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।

কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর প্রায় একই। সে কারণেই প্রবাসীরা এখন অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে দেশে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন বলে জানান ব্যাংকাররা।

চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, রেমিট্যান্স আনতে বিভিন্ন ছাড় ও সুবিধা দেওয়ার পর এমন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সের বিস্ময়কর উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি হবে নতুন রেকর্ড। এতে অনেকটাই চাপমুক্ত হবে দেশ। ইতোমধ্যে সে লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।

এর আগে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে বেশি ছিল ১২ শতাংশ।

এদিকে, আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে অস্বাভাবিক হারে কমছে আমদানি ব্যয়। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। একই সময়ে ঋণপত্র নিস্পত্তির হার কমেছে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।

এর আগে, এক মাসের ব্যবধানে জুলাই মাসে আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৩১ শতাংশ। একইসময়ে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির হার কমেছে ৯ শতাংশ।

এদিকে, ডলার সংকট নিরসনে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় কমাতে সম্প্রতি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই ফলে কমছে আমদানি ব্যয়। সংকট সামলাতে বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরমধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সীমিত করেছে সরকার। আর আমদানি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৭টি পণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি ডলারের ওপর চাপ কমাতে ব্যাংকগুলোর গাড়ি কেনা বন্ধ করা হয়েছে।

এছাড়া, ডলার সংকট মোকাবিলায় ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ব্যাংকগুলোকে এখন থেকে এলসি খোলার ২৪ ঘন্টা আগে বিস্তারিত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে। এসব সিদ্ধান্তের প্রভাবেই আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে।

এদিকে, ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে কয়েক মাস ধরে। বেড়েই চলছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এই মুদ্রার দর। কমছিল টাকার মান। তবে  খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম কমে ১০৯ টাকা নেমে এসেছে। ব্যাংকগুলোতে কয়েক দিন ধরে একই দামে ‘স্থির’ রয়েছে ডলার দর। ডলারের বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এলসি খোলা কমলেও বকেয়া দায় পরিশোধের কারণে ডলারের ওপর চাপ এখনও কমেনি। যে কারণে তদারকির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। গত বৃহস্পতিবার কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত বিক্রি দাঁড়াল ২১২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে রোববার (২৮ আগস্ট) ৩৯ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম অর্থসূচককে বলেন, ‘গত কয়েক মাসে ডলারের দর বেশ খানিকটা বেড়েছে। প্রণোদনার পরিমাণ দুই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে। এসব কারণে প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সে কারণেই বাড়ছে রেমিট্যান্স। তিনি বলেন, ‘জুলাই মাসের মতো আগস্টেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয়ও কমতে শুরু করেছে। এছাড়া, রফতানিপণ্যেও আয় যেন দ্রুত দেশে ফেরত আসে সেই বিষয়টিও আমরা নিশ্চিত করছি। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি আগামী ডিসেম্বর মাসে মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। এর ফলে শিগগিরই ডলারের সংকট কেটে দেশের রিজার্ভও বাড়বে।

অর্থসূচক/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.