ডলার কেনা-বেচায় অনিয়মের দায়ে আরো ২টি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে, গত রোববার তিনটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৫টি মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (০২) আগষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল এ পর্যন্ত ৮০ টি মানি চেঞ্জার পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে ৪২ টি প্রতিষ্ঠানকে ডলার কেনা-বেচায় বিভিন্ন অনিয়মের কারণে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। আর ৫টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
মুখপাত্র জানান, লাইসেন্স ছাড়া ৯টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে বেরিয়ে এসেছে। ডিএমপির মাধ্যমে সেগুলো সিলগালা করার জন্য বলা হয়েছে। কারণ যাদের লাইসেন্স নেই তাদের দেখার দায়িত্ব আইন শৃংখলা বাহিনীর।
তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ডলার নিয়ে কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
ব্যাংকের পাশাপাশি খোলাবাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত সপ্তাহে মানি চেঞ্জার পরিদর্শন শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে ব্যাংকেও পরিদর্শক দল পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে ধানমন্ডি, পল্টন, মতিঝিল, বনানী এলাকার ২২টি মানি চেঞ্জার পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) কর্মকর্তারা। বেশির ভাগ মানি চেঞ্জার নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে না।
আবার কেউ কেউ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছে বলে পরিদর্শনে বেরিয়ে এসেছে। ফলে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে কিছুদিন ধরেই। এক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ।
আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক ডলারের জন্য খরচ করতে হয়েছে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা, তবে সব ব্যাংকেই নগদ ডলারের দাম বেড়ে ১০০ টাকার ওপরে উঠেছে। ১০৫ থেকে ১০৮ টাকায়ও বিক্রি করছে কোনো কোনো ব্যাংক। গত মঙ্গলবার ( ২৬ জুলাই) কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১২ টাকায় বেচাকেনা হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে, বুধবার দিনের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত শুরু করলে বাজারের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিসাবের বাইরে খোলাবাজারের মতো আগে যে ডলার বেচাকেনা হতো, সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, যাদের লাইসেন্স আছে তারা ছাড়াও অনেকে ডলার কেনাবেচনার সঙ্গে জড়িত। যারা এমন ব্যত্যয় ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে জরুরিভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক কাদের লাইসেন্স দিয়েছে সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া ডলার কেনাবেচা করা অন্য প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কি ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে এমন প্রশ্নের জবাবে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডলার সেল করেছে কিন্তু এন্ট্রি করেনি। ডলার বিষয় জানতে চাইলে যথাযথ জবাব পাওয়া যায়নি, মাত্রাতিরিক্ত টাকা পাওয়া গেছে এসব বিভিন্ন অনিয়ম বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে।
খোলাবাজারের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকেও পরিদর্শনের আওতায় আনা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে। যেমন যে ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানি করবে, সেই ব্যাংকের মাধ্যমেই রপ্তানি আয় আনতে হবে। ব্যাংকগুলোর যে ধারণ ক্ষমতা তাও কমিয়ে আনা হয়েছে। কী পরিমাণ ডলার তারা কিনছে এবং কি রেটে কিনছে সেগুলোও তদারকি করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতেও যদি কোন অনিয়ম পাওয়া যায় তাহলে মানি চেঞ্জারদেও মতো তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২৩৫ টি মানি চেঞ্জার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিলেও বাজারে ৭০০’র বেশি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে৷ এদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কি ধরনের পদক্ষেপ নেবে এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনপ্রাপ্ত মানি চেঞ্জার গুলোকে নিয়মিত পরিদর্শন করা হয় এবং কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে সাথে সাথে তাদেও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। লাইসেন্স ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে তাদের ধরার দায়িত্ব আইন শৃংখলা বাহিনীর। এজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছি।
ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরার আভাস দিয়ে মুখপাত্র জানান, ডলার সংকটের কারণে আমরা আমদানিতে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছি। এখন ৩ মিলিয়নের (৩০ লাখ ডলার) বেশি আমদানি এলসি খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে বলা হয়েছে। আগে যেটা ছিল ৫ মিলিয়ন। এতে দেখা যাচ্ছে অনেক এলসিতে অপ্রয়োজনীয় ও বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। আমরা এগুলোর অনুমতি দেইনি। ফলে গত জুনের তুলনায় জুলাই মাসে আমাদের আমদানি এলসি অনেক কমেছে। এছাড়া রেমিটেন্স ও রপ্তানিও বেড়েছে। এসব দিক বিবেচনা করলে আমরা বলতে পারি শিগগিরই ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে আসবে।
এদিকে, মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে বৈদেশিক মুদ্রার অবৈধ লেনদেনে রাজধানীর দিলকুশার উত্তরা ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন শাখা (এডি) থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে। এ তিনজনই দালাল। তারা গ্রাহকদের লোভ দেখিয়ে মানিচেঞ্জারে নিয়ে যাচ্ছিল। এসময় পরিদর্শন দলের নেতৃত্বে ছিলেন বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের জয়েন ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলী।
অর্থসূচক/এমএস



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.