‘আমদানি নির্ভরতাই বর্তমান বিদ্যুৎ সংকটের মূল কারণ’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম বলেছেন, বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানি যোগান না বাড়িয়ে পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হওয়ার কারণেই বর্তমান বিদ্যুৎ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

রোববার (২৪ জুলাই) সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: কতটা ঝুঁকিপূর্ণ’ শীর্ষক বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন তিনি।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সামষ্টিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, ব্যাংকিং খাত নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, বহি খাত নিয়ে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

এ ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

অনুষ্ঠানে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বক্তব্য দেন অধ্যাপক ম তামিম। তিনি বলেন, সরকার বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানির যোগান দিতে না পারায় বা ভুল ধরনের যোগান দেওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে। দ্রুত গতিতে বিদ্যুৎ আনার জন্য এক সময় তেলভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। তবে সেটাকে তিন বা পাঁচ বছর পর্যন্ত রাখার পরামর্শ ছিল। কিন্তু সেটা না করে এখন পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে তেলের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। আর তেলের ওপর এই নির্ভরতার কারণেই আজকের সমস্যা তৈরি হয়েছে।

ম তামিম বলেন, একসময় আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অভাব ছিল ফলে লোডশেডিং ছিল। ২০০৭ সাল থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল কিন্তু প্রাথমিক জালানির অভাব ছিল সেটা এখনো রয়ে গেছে।

রেন্টাল বা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তখন যেটা নেওয়া হয়েছিল সেটা সঠিক ছিল তবে, দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাব ভালো হবে না সেটার জন্য প্রাথমিক জ্বালানির অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে বলা হলেও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এরই প্রভাব পড়ছে এখন।

তিনি বলেন, গ্যাস, কয়লা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি- এই তিনটি আমাদের দেশের নিজস্ব জ্বালানির প্রধান উৎস। এগুলো ছাড়া অন্য কোনো জ্বালানি উৎস নেই আমাদের দেশে। কিন্তু গ্যাস, কয়লা-অভ্যন্তরীণ এই দুটি উৎস থেকে প্রাথমিক জ্বালানির যোগানে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। উপরন্তু আমদানি নির্ভর জ্বালানির নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। অর্থনীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানি করে যাবো এটি ছিল সরকারের নীতি। আর এই নীতির ফলেই বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, দেশে যখন কুইক রেন্টালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুরু হয় তখন কয়লা ও তেল আমদানি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু একই সময়ে উচিত ছিল নিজেদের গ্যাসের জন্য অনুসদ্ধান চালানো। সেটি হয়নি। পরবর্তীতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তাও অনেক দেরি করে নেওয়া হয়েছে।

গ্যাস অনুসন্ধানের ঝুঁকি আছে, নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অনুসন্ধানের সেই ঝুঁকি বা রাজনৈতিক সাহস কোনো সরকারই নিতে পারেনি। অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ দরকার ছিল। কিন্তু ওই সময় বিদেশি বিনিয়োগ না নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। আবার দেশীয় বিনিয়োগের ঝুঁকিটাও কেউ নিতে চায়নি।

ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রকে ভুল মনে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ম তামিম। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র বাদ দিয়ে দিলে তা আমাদের চাহিদা অনুসারে হবে। অনেক আনজাস্টিফাউড ক্যাপাসিটি চার্জ আছে। এগুলোকে বাদ দিতে হবে।

বর্তমানে দেশে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে জানিয়ে ম তামিম বলেন, দেশে যে কোনো সময়ে উৎপাদন কমে যেতে পারে। কেননা বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা থেকে সবচেয়ে বেশি গ্যাস আসছে। এর ফলে এখানকার ২/৩টা কূপ বন্ধ হলে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হবে।

আন্তর্জাতিকভাবেও আমদানি নিয়ে সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন ম তামিম। তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগে থেকেই গ্যাসের দাম বেশি ছিল। যুদ্ধের কারণে দাম আরও বেড়েছে।

ইউরোপ এখন রাশিয়ার ওপর গ্যাস নির্ভরতা কমাচ্ছে। এ জন্য সারাবিশ্বে যত জায়গায় যত গ্যাস আছে তা নিতে ইউরোপ হাত বাড়াবে। সে জন্য আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ, আমরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পারবো কিনা। তাই এটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

পাশাপাশি আমদানিকৃত কয়লার ওপর নির্ভরতা অব্যাহত রাখতে হবে। নিজস্ব কয়লার ব্যাপারেও নতুন ভাবে ভাবতে হবে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম অনেক বেড়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে এখন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যেতে হচ্ছে।

আরেকটি আশা হচ্ছে- নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এটা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। সর্বিকভাবে সাশ্রয় ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের চাহিদা কমিয়ে আনতে পারি।

অর্থসূচক/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.