ঋণ নিয়মিতকরণে এখন থেকে ব্যাংকের পর্ষদই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে

খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণে এখন থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের ধরণ বিবেচনা করে ব্যাংকের পর্ষদ ঠিক করবে, কি ধরনের সুবিধা দেয়া যেতে পারে। তবে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু শর্ত আরোপ করেছে।

পাশাপাশি ঋণ খেলাপিদের আবারও ছাড় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ ৫-৮ বছরে শোধ করা যাবে। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে। তবে নতুন নীতিমালার মাধ্যমে জাল জালিয়াতি ও অনিয়ম-প্রতারণার ঋণ এই সুবিধার আওতায় নিয়মিত করা যাবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সোমবার (১৮ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি এবং নীতি বিভাগ এই সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেয়ার বাধ্য-বাধকতা ছিল। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক যাচাই-বাছাই করে স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন।

 

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। নতুনভাবে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণ পুনঃতফসিলকরণ সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করা হলো।

এতে আরো বলা হয়েছে, এই নীতিমালা ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও পুনর্গঠনের ন্যূনতম মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংকসমূহ ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করবে, যা তাদের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। ব্যাংকের নীতিমালায় প্রজ্ঞাপনে দেয়া শর্তাদির চেয়ে নমনীয় কোন শর্ত যুক্ত করা যাবে না। নীতিমালায় অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অথবা উৎপাদনশীল খাতের অলাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে কঠোর বিধি-নিষেধ থাকতে হবে।

কোন ঋণগ্রহীতা প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের আবেদন করলে ব্যাংক আবশ্যিকভাবে আবেদনপত্র গ্রহণের ৩ মাস সময়ের মধ্যে তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া, ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তনেয়ার আগে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের দায় বিবেচনায় নিয়ে গ্রাহকের সামগ্রিক ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা যাচাই করতে হবে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, শ্রেণিকৃত ঋণ সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতফসিলিকরণ করা যাবে। তবে, খেলাপি ঋণ আদায়ের স্বার্থে বিশেষ বিবেচনায় ৪র্থ বার পুনঃতফসিল করা যাবে। ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে মেয়াদী ঋণে একশ কোটির কম হলে সর্বেচ্চ সময়সীমা হবে ৬ বছর। এক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউন পেমেন্টের হার হবে সাড়ে চার থেকে সাত শতাংশ। ১০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে হলে সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে ৭ বছর এবং ডাউন পেমেন্টের হার হবে সাড়ে তিন থেকে ৬ শতাংশ। ৫০০ কোটি টাকার উপরে হলে সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে ৮ বছর এবং ডাউন পেমেন্টের হার হবে আড়াই থেকে পাঁচ শতাংশ। তবে, তলবী ঋণে ৫০ কোটি টাকার কম হলে সর্বেচ্চ সময়সীমা হবে ৫ বছর এবং ন্যূনতম ডাউন পেমেন্টের হার হবে ৪ শতাংশ , ৫০ থেকে ৩০০কোটির কম হলে সর্বেচ্চ সময়সীমা ৬ বছর এবং ডাউনপেমেন্টের হার হবে ৩ শতাংশ। ৩০০ কোটি টাকার উপরে হলে সময়সীমা হবে সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং ডাউন পেমেন্টের হার হবে আড়াই শতাংশ।

এক্ষেত্রে, কোন গ্রাহকের ঋণ হিসাব ২য় পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ ৭ বছর হলে ৩য় পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ৬ বছর এবং ৪র্থ পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ৫ বছর।

এছাড়া, কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ ১ম বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৩ বছর এবং ২য় ও তৎপরবর্তী প্রতিবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ২ বছর ৬ মাস। ঋণের পরিমাণ বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে গ্রেস পিরিয়ড ০৬ মাস হবে। তবে, গ্রাহকের ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় উক্ত গ্রেস পিরিয়ডের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১ বছর নির্ধারণ করা যাবে।

প্রজ্ঞাপনের আওতায় ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের পর পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ন্যূনতম ৩ শতাংশ (রপ্তানিকারক ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রে ২ শতাংশ) নগদে আদায় সাপেক্ষে ঋণগ্রহীতাকে নতুন ঋণ সুবিধা প্রদান করা যাবে এবং ঋণগ্রহীতার বিদ্যমান ঋণসীমা বৃদ্ধি করা যাবে। তবে, নতুন ঋণ মঞ্জুরী বা ঋণসীমা বৃদ্ধির পূর্বে গ্রাহক প্রকৃতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মর্মে ব্যাংক কর্তৃক নিশ্চিত হতে হবে। এছাড়া, দীর্ঘদিনের পুরাতন খেলাপি ঋণগ্রহীতাদেরকে নতুন ঋণ প্রদানে ব্যাংক কর্তৃক সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

নিয়মিত মেয়াদী ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নিয়মিত (অশ্রেণিকৃত: স্ট্যান্ডার্ড বা এসএমএ) মেয়াদী ঋণের বিদ্যমান অবশিষ্ট মেয়াদের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেয়াদ বর্ধিত করে ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে। কোন ঋণ হিসাবকে ঋণের মেয়াদের মধ্যে শুধুমাত্র একবার এরূপ পুনর্গঠন সুবিধা প্রদান করা যাবে। এক্ষেত্রে কোন প্রকার ডাউন পেমেন্ট গ্রহণ না করে মেয়াদী ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে। ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদ/নির্বাহী কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। পুনঃতফসিলকৃত কোন ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে না।

প্রজ্ঞাপনেদেয়া শর্ত অনুযায়ী, তলবী ঋণ, চলমান ঋণ বা মেয়াদী ঋণ বিভিন্ন প্রকৃতির হওয়ায় এ জাতীয় ঋণসমূহকে একত্রিত করে একক ঋণ হিসেবে পুনঃতফসিল করা যাবে না। তবে, একই প্রকৃতির একাধিক ঋণ হিসাবকে (পুনঃতফসিলের ক্রম একই হওয়া সাপেক্ষে) একত্রিত
করে একক ঋণ হিসেবে পুনঃতফসিল করা যাবে। শ্রেণিকৃত কোন ঋণ এ প্রজ্ঞাপন জারির আগে চার বা ততোধিক বার পুনঃতফসিলকৃত হলে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ হিসাবটি সর্বশেষ একবার পুনঃতফসিল করা যাবে যা ৪র্থ বার হিসেবে গণ্য হবে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত এরূপ পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ থাকবে।

৪র্থ বার পুনঃতফসিলিকরণের পরও কোন ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে ব্যাংক আবশ্যিকভাবে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাল-জালিয়াতি বা অন্য কোন ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণের ক্ষেত্রে এসব সুবিধা প্রদান করা যাবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।

খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, করোনার কারণে দেওয়া ছাড় উঠে যাওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নতুন করে অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি করোনায় অর্থনীতি গতি ধরে রাখতে যে এক লাখ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, তারও বড় একটা অংশ অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। এই কারণে এখন ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃ তফসিল করতে বিভিন্ন তদবির আসত। এই কারণে নতুন গভর্নর সেই সুবিধা দেওয়ার ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে দিয়েছেন। পাশাপাশি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিতে পড়া অর্থনীতি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ঋণ পুনঃতফসিলে ছাড় দিয়েছেন। না হলে বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পুরো আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.