‘মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে’

আইসিএবি’র গোলটেবিল আলোচনা

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার হিসেবে পরিচিত রেপোর সুদের হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এই নীতি সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে ব্যাংকগুলোকে এখন বেশি সুদ দিতে হবে। এতে করে ব্যাংক ঋণের ওপর প্রভাব পড়বে। বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ও কিছুটা কমানো হয়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে । যা সরকারের অষ্টম ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাথে সাংঘর্ষিক। অষ্টম-পঞ্চম পরিকল্পনাতে বিনোয়োগে জোর দেওয়া হলেও, তবে মুদ্রানীতিতে তার প্রতিফলন তেমন দেখা যাচ্ছে না।

দি ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ বাংলাদেশ (আইসিএবি) বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) সিএ ভবনে “চলমান অর্থনৈতি প্রেক্ষাপটে মুদ্রানীতি ২০২২-২৩” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন । এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম । এতে বক্তব্য রাখেন আইসিএবি’র প্রেসিডেন্ট মো: শাহাদাৎ হোসেন এফসিএ, ভাইস প্রেসিডেন্ট এনকেএ মবিন এফসিএ, ফৌজিয়া হক এফসিএ, সানেম নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, বিল্ড এর নির্বাহী পরিচালক ফেরদৌস আরা বেগম, বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনস্টিটিউট নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ড. মাহমুদা আক্তার, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ, আইসিএবি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশীষ বসু ।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি অর্থনীতির ওপর অর্থনীতির সাফল্য নির্ভর করে । কোভিডকালীন অর্থনীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সারা বিশ্বে পঞ্চম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম হয়েছে। আমরা সফলভাবে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি । এখন মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব মোকাবেলা বড় চ্যালেঞ্জ। অধিক আমদানির কারণে আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে যার প্রভাব আমাদের দেশে পড়েছে । আমাদের অর্থনীতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। তাই ছয় মাস পর পর সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা উচিত। ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে সরকার সংকোচন মূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে । অপ্রয়োজনীয় বিলাস জাত আমদানী পণ্য সুনির্দিষ্টায়ন সবার কাছে নেতিবাচক বার্তা যাবে। তাই এখন এ নিয়ে সরকার ভাবছে না।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয়, সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্য সরকার ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করেছে। সুদের হার বাজারে ছেড়ে দিলে মূলধন ব্যয় বাড়বে। ফলে পণ্যের দামও বাড়বে। তাই বর্তমানে এক অংকের সুদের হার উঠিয়ে দেওয়ার কথা সরকার চিন্তা করছে না।

আইসিএবি’র প্রেসিডেন্ট মো: শাহাদাৎ হোসেন বলেন, রাজস্ব নীতির মতোই মুদ্রানীতির বিস্তৃত উদ্দেশ্য হল উৎপাদনে পূর্ণ-কর্মসংস্থান স্তরে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, মূল্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করা। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে পূর্ণ কর্মসংস্থানের পাশাপাশি, শিল্প ও কৃষি উভয় ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত এবং উৎসাহিত করতে একটি গ্রহণযোগ্য মুদ্রানীতি প্রণয়ন জরুরি। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের জন্য পণ্যমূল্য কমাতে তদারকি জোরদার ও আমদানির বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে হয়তো এককভাবে এদিকে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে জানান তিনি।

কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে চলমান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে সমর্থন অব্যাহত রাখাও মুদ্রানীতির জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তা ডলার–সংকট নিয়ে। ইউক্রেনের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নিয়েও তাঁদের শঙ্কা আছে। সুতরাং স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েই সংকট মোকাবিলা করতে হবে তিনি মনে করেন।

আইসিএবি’র প্রেসিডেন্ট বলেন, মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করার হাতিয়ার বেসরকারি ঋণ সংকোচন মূলক মুদ্রানীতি প্রকৃত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে কিনা সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি এবং বেকারত্বের পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সানেম নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ওপর জোর দিতে হবে। সুদের হার কমিয়ে কোন লাভ হয়নি । ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে ভবিষৎতে মূলস্ফীতির চাপ আগামীতে বাড়তে পারে। মূলস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ করা বর্তমানে অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ।

বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনস্টিটিউট এর নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ড. মাহমুদা আক্তার বলেন,কৃচ্ছতা অ্লম্বন করে সরকার সংকোচন মূলক নীতি গ্রহণ করেছে । পুঁজিবাজার সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার। সামগ্রীক অর্থনীতি উন্নতি হলে পুঁজিবাজার উপকৃত হবে। নীতি করের সুদ বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন। কোভিড পূর্ববর্তী নীতিগুলো অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।

বিল্ড এর নির্বাহী পরিচালক ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, প্রবৃদ্ধি অর্জন , মুদ্রানীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ মাথায় রেখে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে । প্রকৃতপক্ষ্যে বিলাসজাত পণ্যে আরোপিত করের পরিমাণ প্রায় আগের মতোই আছে। ফলে বিলাসজাত পণ্য আমদানী রোধ হবে বলে মনে হচ্ছে না। সুদের হার ৫% থেকে বাড়িয়ে ৫.৫% করা হয়েছে। এতে করে ব্যাংক লোনের ওপর প্রভাব পড়বে। উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগ কমে যাবে। অষ্টম-পঞ্চম পরিকল্পনাতে বিনোয়োগে জোর দেওয়া হলেও, তবে মুদ্রানীতিতে তার প্রতিফলন তেমন দেখা যাচ্ছে না।

অর্থসূচক/এমএস/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.