ঋণ পরিশোধে আবার ছাড়ের বিষয়ে পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক

খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে আবার ঋণ পুনঃতফসিলের বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা। কেউ বলছেন, এই সুবিধার অপব্যবহার করেছেন ব্যবসায়ীরা। আবার কেউ বলছেন, এই সুবিধার ফলে অনেক ব্যবসায়ী ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঢালাও সুবিধা না দিয়ে শর্ত সাপেক্ষ নতুন করে এই সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবছে।

এর আগে, মঙ্গলবার (৩১ মে) চলতি বছরের (২০২২ সাল) ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুবিধা চেয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপির আওতামুক্ত থাকতে চান তারা। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এই সুবিধা চেয়েছেন তারা।

বৃহষ্পতিবার (১৬ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের অনুষ্ঠিত সভায় এই পর্যালোচনার কথা জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এসময় সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক ও সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।

গভর্নরের মেয়াদ আগামী ৩ জুলাই শেষ হচ্ছে, এজন্য এটাই ছিল তার শেষ ব্যাংকার্স সভা। এজন্য সভায় অনেক ব্যাংকার তাকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানায়।

সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, গভর্নর চলে যাচ্ছেন, এ জন্য সবাই বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের দাবি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ ডাউন পেমেন্টে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সুবিধা দেয়ার বিষয় বিবেচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সুবিধা দেয়া হতে পারে। চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না আসলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ দুই বছর ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুবিধা পেয়েছে।  যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তারাও এই সুবিধা নিয়েছে। অনেক ভাল প্রতিষ্ঠান এ সময়ে ঋণ পরিশোধের সুযোগ থাকলেও তারা ঋণ পরিশোধ করেনি। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি সচল তাই নতুন করে সুবিধা দিলে ব্যাংকগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হবে। হতাশ হবেন ভালো গ্রাহক। তাই এই সুবিধার বিরোধিতা করেছেন এমডিরা।

আবার কিছু ব্যাংকের এমডি যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন, নতুন করে ঋণ সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে। কারণ এখনো পুরোপুরি করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠেনি আর্থিক খাত। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে সকল ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তাই নতুন করে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ ডাউন পেমেন্টে জমা নিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মরাটোরিয়াম সুবিধা দেওয়া হোক।

এসময়, মুদ্রানীতির ওপর সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেন প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। এতে তিনি মুদ্রানীতির অর্জন ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, অর্থঋণ আদালতে ঝুলে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয় সে বিষয়ে জোর দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কারণ অভিজ্ঞ আইনজীবির অভাবে অনেক সময় মামলাগুলো দীর্ঘায়িত হয়ে পড়ে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাংকের ঋণ আদায় কার্যক্রম। মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোর ২ লাখ ৯ হাজার ২২৭ কোটি টাকা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ১৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা মামলায় আটকে আছে। এতে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব মামলা এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত তদারকি করবে বলে সভায় জানানো হয়েছে।

বৈঠক শেষে এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেইন বলেন, যেহেতু গভর্নর ফজলে কবিরের এটাই শেষ মিটিং তাই বিগত সময়গুলোতে ঘটে যাওয়া ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকে অভিজ্ঞ আইনজীবি নিয়োগ ও এফবিসিসিআই এর আবেদন ছিল অন্যতম। এসব বিষয়ে এখনো কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। এর জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

তিনি আরও জানান, ব্যাংকারদের জন্য একটি বিশেষ হাসাপাতাল নির্মানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেমন পুলিশ বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর জন্য রয়েছে। তাদের মতো ব্যাংকার ও তাদের পরিবারের জন্য বিশেষ হাসপাতাল থাকলে করোনার মতো গুরুতর সময়গুলোতে ভোগান্তি কম হবে।

এক্সচেঞ্জ রেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পর এইরেট কিন্তু স্টেবল আছে।

এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকই যেন এই আদায়ের হারটা বাড়াতে পাড়ে সেজন্য প্রতিটি ব্যাংকে আলাদা একটি সেল গঠনের কথা হয়েছে। আগামী ৫/৬ মাসের মধ্যে খেলাপি ঋণ আদায়ের হার আরো অনেক বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অর্থসূচক/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.