‘পদ্মা সেতুকে ইকোনোমিক জোন করা হলে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ হবে’

আইসিএবি ও ইআরএফ আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা

পদ্মা সেতু কেবল যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করলে চলবে না। এটা আমাদের জাতীয় আকঙ্খার প্রতীক। এই সেতুকে ইকোনোমিক করিডর করতে হবে। একে কেন্দ্র করে ইকোনোমিক জোন ও শিল্প পার্ক গড়ে তুলতে পারলে সেটি জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে অবদান রাখতে পারবে।

শনিবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার সিএ ভবন অডিটোরিয়ামে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ বিষয়ক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)’র সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি’ (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান, গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিড এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ, আইসিএবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশীষ বোস, বার্তা সংস্থা এএফপির ব্যুারো চিফ এম শফিকুল আলম,ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম প্রমূখ আলোচনায় অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আইসিএবির সভাপতি মো. শাহাদাৎ হোসেন ও ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি হুমায়ন কবীর।

 

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মাসেতু জাতীয় আকঙ্খার প্রতীক। এটা শুধু পরিবহনের জন্য ব্যবহার করলে চলবে না, এটাকে ইকোনোমিক করিডর করতে হবে। পদ্মাসেতু ঘিরে ১৭টা ইকোনোমিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। সেগুলো করতে হবে। তাহলে জাতীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখতে পারবে।

 

তিনি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতা আমাদের উন্নয়নের বড় বাঁধা। যেমন এখনও এনবিআরের কর আদায়ে অনেক ঘাটতি আছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে কিন্তু রেভিনিউ জিডিপি কমছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগে বিনিয়োগ করার উপযুক্ত করতে হবে। প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ দরকার, বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি আসবে না।

অনুষ্ঠানে পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা যেমন জরুরি, তেমনি টাকার মান বাড়াতে হবে। যেমন রাশিয়াকে সাপোর্ট করে বলছি না, তবে একটা কথা বলছি দেশটি রুবলকে আকর্ষণীয় করেছে আমাদেরও এটা করতে হবে।

 

তিনি আরও বলেন, দর্ঘদিন ধরে মার্কিন ডলারের দাম ৮২, ৮৩, ৮৪ এর মধ্যে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এটা কেন এমন হলো এর একটা কারণ আছে। কোভিডের সময় কোন সমস্যা হয়নি। এখন হঠাৎ করেই এটা সমস্যা হয়েছে এই সমস্যা নিরসন করে এক্সচেঞ্জ রেট ঠিক রাখতে হবে।

 

বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের বাজেট জিপিডির মাত্র ১৪ শতাংশ। যেটা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। আবার আমাদের বাজেটের একটা বড় ব্যয় চলে যায় বেতন ভাতা দিতে। বাকি টাকা সরকারি উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করা হয়। বাজেট জিডিপির ২০ শতাংশ করলে ভালো।

 

আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রকল্প ভেবে চিন্তে নিতে হবে যাতে করে রিটার্ন ভালো আসে। আমরা জানি এবার রেলখাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। এই টাকা কবে রিটার্ন পাবো আমরা জানি না।

 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ধীরে ধীরে কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া থেকে সরে আসা উচিত। কারণ গ্রামের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামে বাড়ি ঘরের রূপ পরিবর্তন হয়েছে, খাওয়া-পড়ার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়েছে, ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে। সরকারের অবদানের কারণেই এই পরিবর্তন হয়েছে। সারসহ কৃষিতে সরকারের ভর্তুকির ফলেই গ্রামে কৃষকের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিকভাবে সারের দাম বাড়ছে। তাই এখন ধীরে ধীরে এই ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।

শ্রীলঙ্কা ভীতি রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, কৃষিতে ভর্তুকি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেওয়া হয়। শ্রীলঙ্কাও অর্গানিক কৃষিতে গিয়েছিল, ফেল করেছে। তাই খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কৃষিকে সব সময় আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এ বিষয়ে সরকার সবসময় সচেতন রয়েছে।

রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢালাওভাবে প্রণোদনা দেওয়ার পক্ষে আমি নই। যারা মাসে ২ থেকে ৩শ ডলার রেমিট্যান্স পাঠায় তাদের প্রণোদনা দেওয়া দরকার। এর আগে, যখন ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কথা হয়েছিল, তখনও আমি বলেছিলাম, ঢালাওভাবে প্রণোদণা দেওয়া ঠিক হবে না। ঢালাওভাবে প্রণোদনা দিলে অনেকে টেবিলের নিচ দিয়ে অর্থ পাঠিয়ে ওপর দিয়ে এনে ঘরে বসেই প্রণোদনা নেবে।

তিনি বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রবাসীদের রেকর্ড আছে। কারা কতোদিনের জন্য কোন দেশে যাচ্ছেন, সেই রেকর্ড ধরেই প্রণোদনা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এখন শুনছি আড়াই-তিন বা কোন কোন ব্যাংক নাকি নিজেরাও আরো হাফ অ্যাড করে দিচ্ছেন। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদরাও অনেকেই কথা বলেছেন। তবে এ নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হবে। তিনি বলেন, এখন কার্বওয়ালারাও (খোলা বাজারে) পিছু হটতে (ডলারের দাম কমাতে) বাধ্য হয়েছে। আমি মনে করছি এটা কমিয়ে আনা দরকার এবং যথাযথভাবে দেওয়া দরকার।

অপচয়রোধ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমি একনেক মাঠে, আমি কাজ করি। সরকার প্রধানের নির্দেশে আমরা অপচয় রোধ করতে কাজ করছি। মাঝে মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আয়েশিভাব চলে আসছিলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা আমরা রোধ করার চেষ্টা করছি। এখন ১৮শ প্রকল্প আছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে এগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থাৎ গুরুত্ব অনুসারে এই প্রকল্পগুলোকে সাজানো হবে। কোনটা আগে প্রয়োজন কোনটা পরে আবার কোনটা এখন প্রয়োজন নেই সেটা বের করা হবে।

বিআইডিএস মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, আমরা কেন শ্রীলঙ্কা হবো? আমাদের অর্থনীতির যে চারটি ড্রাইভার আছে তা ঠিক আছে। আমাদের কৃষি খাতে ভালো আছে। এছাড়া রপ্তানি আয় ভালো। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রপ্তানি আয় ছিল ৪৪ শতাংশ। এছাড়া নন- এক্সপোর্ট ম্যানুফ্যাক্চারিং ও ভালো। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছি। তবে রেমিট্যান্স কিছুটা কমেছে। চারটা ড্রাইভারের মধ্যে তিনটাই ভালো।’

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমি কোন চাপ দেখছি না। তবে হঠাৎ করে আমদানি ৬০ শতাংশ হয়েছিল। এটার কারণ আছে দীর্ঘদিন কোভিড ছিল। কোভিডের পর মানুষ কেনাকাটা করেছে। এছাড়া অনেক শিল্প কারখানায় কাঁচামাল প্রয়োজন হয়। তবে বর্তমানে ৬০ শতাংশ থেকে আমদানি কমে ২৮ শতাংশ হচ্ছে।’

এমসিসিআই সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম রেমিট্যান্সের উপর যে পরিমাণ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে-সোট বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, সারের দাম বাড়ায় ভর্তুকির পরিমাণ আরো বাড়ানো দরকার। কেননা বর্তমান বাস্তবতায় খাদ্য নিয়ে কোন ধরনের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ব্যাংকরেট ও কার্ব মার্কেটে ডলারের দামেরক্ষেত্রে ৬-৭ টাকা ব্যবধান হয়ে গেছে। যা দ২-৩ টাকার বেশি হওয়া উচিত না। তাহলে বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে। তাই এটা প্রতিরোধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান তিনি।

 

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.