মায়ের মৃত্যু শোকে ইনসমনিয়া। তা থেকেই কি মেহেদীর ‘আত্মহত্যা’?

শৈশবে বাবাকে হারিয়েছেন। অনেক কষ্ট করে সন্তানকে বড় করেছেন মা। সন্তান নিজেও করেছেন অনেক সংগ্রাম। মেধাবী ছেলেটি একাধিক চাকরি পরিবর্তন করে একটি ভাল চাকরি পাওয়ার ক’দিন আগেই মারা যান তার মা। তাতেই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি। শোক থেকে শুরু হয় অনিদ্রা। এক সময় তা পরিণত হয় ভয়ানক অনিদ্রা রোগ ইনসমনিয়ায়। এই ইনসমনিয়া-ই কেড়ে নিয়েছে মেধাবী তরুণটিকে!

বলছি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসানের কথা। রোববার (২৯ মে)  রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার পান্থপথ এলাকার একটি বাসা থেকে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার মৃত্যুকে বেশ রহস্যজনক মনে করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা, যদিও তদন্ত শেষ হওয়ার আগে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়।

এরই মধ্যে ফেসবুকে মেহেদী হাসানের মৃত্যু নিয়ে একটি হৃদয়বিদারক পোস্ট দিয়েছেন তার বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেওয়া তানজিল এইচ রাফি। আর তাতেই তিনি শৈশবে মেহেদীর বাবাকে হারানো, পরে মাকে হারানোর শোক, ইনসমনিয়াসহ নানা তথ্য উল্লেখ করেছেন। তার সন্দেহ, দিনের পর দিন ঘুমাতে না পারার চাপে আত্মহত্যার মাধ্যমে হয়তো ইনসমনিয়া থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে মেহেদী।

মেহেদী বাসা থেকে উদ্ধার করা একটি চিরকুটকে সুইসাইড নোট বলে মনে করা হচ্ছে। এতেও অনিন্দ্রার বিষয়টি উল্লেখ আছে। লেখা আছে, নিদ্রাহীনতা আর সহ্য করতে পারছি না।

ফেসবুক পোস্টে তানজিল যা লিখেছেন, পাঠকদের জন্য নিচে তা হুবহু তুলে দেওয়া হল-

‘মেহেদীর জানাজা পড়ে আমরা ফিরতেছি। এর মধ্যে ইনবক্সে কয়েকজন কিছু অনলাইন নিউজ লিংক দিলো যে মেহেদী নাকি বিসিএস উন্মাদনার শিকার।

সাংবাদিক ভাইকে বলি আপনি ওর সম্পর্কে কতটুকু জানেন? কিসের ভিত্তিতে আপনারা এইসব তথাকথিত অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেন?

মেহেদী ফিন্যান্স ১৯ ব্যাচের অতি পরিচিত হাস্যোজ্জ্বল মুখ। খুবই স্ট্রং মেন্টালিটির ছেলে ছিলো ও। সবাই তাদের দুঃখের গল্পগুলো ওর সাথে শেয়ার করতো। বাংলাদেশের জব মার্কেটের প্রথম শ্রেণির অনেক আকর্ষনীয় চাকুরী ও পেয়েছে। কিছুদিন পর দুর্নীতি দমন কমিশন এর সহকারী পরিচালক (AD) পদের রেজাল্ট দিবে। সেখানেও ওর নাম আছে (ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়)।

২ বছর বয়সে ও তার বাবাকে হারায়। প্রচন্ড স্ট্রাগলিং ফ্যামিলি থেকে উঠে আসলেও নটরডেম কলেজ, ঢাবি ফিন্যান্স থেকে শুরু করে জব মার্কেট- কোনটাতেই সে কখনো পিছিয়ে থাকেনি। এক বছর আগে জব এ ঢুকার ঠিক আগেই ওর আম্মু মারা যায়। মূলত তখন থেকেই ওর ভেংগে পড়া শুরু হয়। ওর মনের মধ্যে একটা জিনিস দানা বাঁধে যে আমি আমার ফ্যামিলির জন্য কিছুই করতে পারলাম না..

ইনসোমনিয়া এক ভয়াবহ ব্যাধি। দেখা হইলেই বলতো ৩/৪ রাত এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। শেষ দিকে বলতো ৭/৮ রাত ও ঘুমাতে পারেনি। ওর বন্ধুবান্ধব ওকে যথেষ্ট সাপোর্ট করেছিলো, কর্মস্থল BSEC এর কলিগ/স্যার রাও ওর প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন।

বাংলাদেশের সব বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছিলো ও। কেউ স্পেসিফিক কোন কিছু আইডেন্টিফাই করতে পারেনি। শুরুর ডাক্তার খুবই হাই পাওয়ার স্লিপিং ডোজ দিয়েছেন এর জন্য কম পাওয়ারফুল এবং শেষ দিকে বেশি পাওয়ার ঘুমের ওষুধ খেয়েও ও অনেকবার ঘুমাতে পারেনি। আবার কোন সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছে এসব মেডিসিন খেলে তো আপনি পাগল হয়ে যাবেন, এটা শুনে সে ঘুমের ঔষধ খাওয়া বাদ দেয়ার চেস্টা করে এবং একপর্যায়ে ইনসোমনিয়া চরম আকার ধারণ করে…

লাস্ট এক বছরে চাকুরী এর চেয়ে জীবনটাই ওর কাছে মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ও বলতো আগে বেঁচে থাকি, তারপরই না বিসিএস। বিসিএস ক্রেজ দূরে থাক ও পড়ালেখাই করতো না…

ওকে ইন্ডিয়া নেয়ার প্রসিডিওর শুরু হয় মাত্র, তার আগেই ও জীবন থেকে নিজেকে ছুটি দিয়ে দেয়। মূলত শেষদিন পর্যন্ত ও চেষ্টা করেছে বেঁচে থাকার। কিন্তু কতক্ষন না ঘুমিয়ে থাকা যায়? তারপর…..

তাই মেহেদীর মৃত্যু নিয়ে মুখরোচক গল্প না বানানোর অনুরোধ করছি। আপনারা সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন। জীবিত অবস্থায় ও ঘুমাতে পারেনি, কবরে যেন ও শান্তিতে ঘুমাতে পারে। মহান আল্লাহ পাক যেন তার কষ্ট লাঘব করেন, মেহেদীকে যেন জান্নাতবাসী করেন (আমিন)

(সংযুক্তিঃ মেহেদীর লিখা শেষ নোট)’

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.