দরিদ্র মানুষের সঙ্গে বাড়ছে কোটিপতিও!

মহামারি করোনার প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতি সচল হতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেশীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এতে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি-পেশার বেশিরভাগ মানুষের আয় কমলেও গুটিকয়েক মানুষের আয় বেড়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। অর্থাৎ বর্তমানে তীব্র আকার ধারণ করেছে আয় বৈষম্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশে এখন কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা এক লাখ ১ হাজার ৯৭৬টি। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে আট হাজার ৮৬টি। শুধুমাত্র করোনাকালীন সময়ে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ১৯ হাজার ৩৫১টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার সময়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। বিনিয়োগকারীরাও নতুন বিনিয়োগে আসছেন না। ফলে একদিকে যেমন মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে অন্যদিকে ব্যাংকে বিনিয়োগকারীদের অলস অর্থ জমা হচ্ছে। এতে দেশের আয় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। যদিও এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় দেশে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ছে। সেইসঙ্গে কোটিপতির সংখ্যাও বেড়েছে।

এছাড়া, দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকা অর্জন, হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ভিন্ন খাতে স্থানান্তর, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায়ও দেশের আয় বৈষম্যের অন্যতম কারণ। এসব কারণে এক শ্রেণির মানুষের বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। তবে আয় কমেছে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর উপর সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ডিসেম্বর শেষে দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক কোটিপতি আমানতকারীর ব্যাংক হিসাব সংখ্যা এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টি। যা আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে ছিল এক লাখ ২৩৯টি। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে কোটিপতির হিসাব সংখ্যা বেড়েছে এক হাজার ১৩৭টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চে দেশে যখন করোনা হানা দেয় তখন ব্যাংক খাতে কোটি টাকার বেশি আমানত রাখার হিসাবের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। মহামারি চলাকালে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরেই কোটিপতি হিসাবের ওই অংক এক লাখ ছাড়ায়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়ায় এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে। এ হিসেবে মহামারির ২১ মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ১৯ হাজার ৩৫১টি।

এদিকে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক সাম্প্রতিক জরিপে এসব তথ্য জানা গেছে।

জরিপে বলা হয়েছে, মহামারি শুরু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব অনেক বেশি। অতি ধনীদের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩৭ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা লকডাউনের আগে ছিল ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই কোভিড-১৯-এর লকডাউন আয় বৈষম্যও বাড়িয়েছে। যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অর্থসূচককে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। এ সময় সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগে করছেন না। ফলে একদিকে যেমন বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের এসব অর্থ ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা হচ্ছে। এছাড়া, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেওয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখা হতে পারে। মূলত দেশে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণেই আয় বৈষম্য বাড়ছে। এজন্য সরকারকে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকে আরো বেশি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। আর তা না হলে দেশে আয়-বৈষম্য আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৪টি। যেখানে জমা ছিল ১৫ লাখ ১২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটি টাকার বেশি হিসাবে জমা ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা ছিল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ওই সময় মোট আমানতের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৩টি। যাদের হিসাবে জমার পরিমাণ এক লাখ ৬৬ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১৭ হাজার ৯টি হিসাব। তাদের হিসাবে জমার পরিমাণ এক লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২০ কোটি থেকে ৫০ কোটির উপরে মোট হিসবাধারীর সংখ্যা ৫ হাজার ৮৪টি। এই হিসাবগুলোতে জমার পরিমাণ তিন লাখ ২৮ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবেন, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এই সংখ্যা বেড়ে ৪৭ জনে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জনে। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৯৪৩ জন। ১৯৯৬ সালের জুনে দেশে কোটিপতি ছিলেন ২ হাজার ৫৯৪ জন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জনে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৮৭ জনে। ২০০৮ সালে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারী গ্রাহক ছিলেন ১৯ হাজার ১৬৩ জন।

অর্থসূচক/এমএস/ এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.