সংকটে সরকারি-বেসরকারি খাতের ৯ ব্যাংক

এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২২ হাজার কোটি টাকা

ঋণ পরিশোধে নানা সুবিধা দেওয়ার পরও ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। সেই বর্ধিত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের ৯ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৪টি ও বেসরকারি খাতের ৫টি ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ২২ হাজার ২৭৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যার সিংহভাগই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের জনতা, বেসিক, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে। এ ছাড়াও ঘাটতির তালিকায় আছে বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি, বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়েছে।

ঋণের মানদণ্ড অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

ব্যাংকাররা বলছেন, করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কারণে চলতি বছরেও ঋণ পরিশোধে শিথিলতা রয়েছে। ফলে মন্দ বা খেলাপি ঋণ বাড়লেও ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ এসব ব্যাংক।

অন্যদিকে, খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়ায় তা আদায় হচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ছাড়ের কারণে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণও বেড়েছে।

তাদের মতে, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। অন্যদিকে, প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিতে পড়ারও আশঙ্কা থাকে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৯১ কোটি ২ লাখ টাকা। যা আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৫ হাজার ১১৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংকটিতে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এরপরই বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ১১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ২ হাজার ৬১৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ২০৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

বেসরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৮৪৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের তিন হাজার ২৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১৬ কোটি ১৮ লাখ, আইএফআইসি ব্যাংকে ২১২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২০৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি ১৪৯ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার পরও বিদায়ী বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে মোট ৮০ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকার প্রভিশন রাখার প্রয়োজন ছিল। আর এসময়ে ব্যাংকগুলো রেখেছে ৬৬ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি হয়েছে ১৪ হাজার ৭ কোটি টাকা।

কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত (উদ্বৃত্ত) অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখেছে। ফলে বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে সার্বিকভাবে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম হয়েছে।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.