থার্ড পার্টি বীমা একটা ধাপ্পাবাজি, আমি নিজেও ভুক্তভোগী: প্রধানমন্ত্রী

থার্ড পার্টি মটর বীমাকে একটা ধাপ্পাবাজি বীমা বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, থার্ট পার্টি বীমা একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। এটা একেবারে ধাপ্পাবাজি, ধোকাবাজি ছাড়া কিছুই না। কারণ আমি নিজেও এর ভুক্তভোগী। তিনি আরো বলেন, থার্ড পার্টি বীমা মানেই একটা লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালানো। এর ফলাফল হলো- যিনি বীমা করেছেন তিনি ভাবছেন আমি টাকা বাঁচালাম।

মঙ্গলবার বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) আয়োজিত জাতীয় বীমা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি অনুষ্ঠানে যুক্ত হন। ‘বিমায় সুরক্ষিত থাকলে, এগিয়ে যাব সবাই মিলে’ প্রতিপাদ্যে এদিন সারাদেশে দিবসটি পালিত হয়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় বিমা দিবসের আলোচনা সভা। প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনসহ বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন এবং বিআইএর সভাপতি শেখ কবির হোসেন উপস্থিত ছিলেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন।

বিমা দিবস উদ্বোধনের আগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বিমা চালু করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ঈশান আজান (অটিজম) ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী রিমিকে পলিসি হস্তান্তরের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বিমার উদ্বোধন করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ তৎকালীন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করেন। তাই জাতির পিতার স্মৃতি বিজড়িত ১ মার্চকে ‘জাতীয় বিমা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি আদেশ জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

অনুষ্ঠানে ছোটবেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হঠাৎ একটা পাটের গুদামে আগুন লেগে যেতো। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে সব পাট পুড়ে যেতো আর বীমা কোম্পানির কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা নিত। একবার এটা খোঁজ করে দেখা গেলো, আসলে মালিকরা পাট বিক্রি করে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিত। তিনি বলেন, একই ঘটনা আমি পেয়েছি গার্মেন্টস খাতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যেতো ঘন ঘন শুধু আগুন লাগে। আমার সন্দেহ হলো। আমি এর নজরদারি শুরু করলাম। ঠিক দেখা গেলো ঘটনা তাই। পয়সা দিয়ে একটা লোক ঠিক করে আগুল লাগিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে বিশাল অঙ্কের টাকা দাবি করল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা দুই নাম্বারি করে বীমার টাকা নিতে চায় এটা আরো ভালো করে দেখতে হবে। বীমা দাবি নিষ্পত্তি ও বীমার আর্থিক লেনদেনে আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। বীমা মানে একটি আমানত। এটা যেন কেউ এমনিতেই নিতে না পারে। আবার কেউ যেন এটা পেতে ভুক্তভোগী না হয়, সহজেই পেতে পারে- সেই বিষয়েও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।

বিমা নিয়ে মানুষের আস্থা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রাহকের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিমা সেবা দিতে হবে। মানুষকে বিমার বিষয়ে আগ্রহী করতে নতুন নতুন পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে। জনগণকে উৎসাহী করতে হবে। আমার একটা অনুরোধ থাকবে, এ সেবাটি যদি মানুষ হাতের কাছে পায়, তাহলে অনেকে কিন্তু তার জীবনের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে। সেজন্য সরকারি-বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সততার সঙ্গে কাজ করলে সব পক্ষ লাভবান হবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি জানি আমাদের অনেক ব্যবসায়ীরা আছেন, যারা হয়তো এক্সপোর্ট করছেন বা ইমপোর্ট করছেন। তারা ইন্সুরেন্স করেন না, ওই সামান্য টাকা দিতে হয় সেজন্য। কিন্তু যখন দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তার যে বিশাল লোকসান হয়ে যায়, সেটা সে ভুলে যায়। এই ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা আপনাদের নিতে হবে। প্রচার প্রচারনা নিতে হবে, এটা না করলে কী ক্ষতি হতে পারে আর করলে কী লাভ হতে পারে।

বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, বিমা ব্যবস্থাকেও ডিজিটাইজ ও অটোমেশনের মধ্যে আনতে হবে এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি বিমাখাতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গ্রাহকের আস্থা অর্জনে ইউনিফাইড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম (ইউএমপি) পদ্ধতি চালু করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ছয় দফা: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিমা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, তাই বিমার প্রতি নিজের অনুরাগের কথাও তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তা টাইপ করে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. হানিফ। শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে প্রশ্ন করেন, ছয় দফা কে লিখল, কীভাবে লিখল? কারা কারা ছিল? হয়তো অনেক বিশেষজ্ঞ ছিল। বিষয়টা তা নয়, এই আলফা ইনসুরেন্স কোম্পানির অফিসে বসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এটা রচনা করতেন। আর এটা টাইপ করেছিল মোহাম্মদ হানিফ। দিনের পর দিন তিনি বসে বসে ছয় দফা প্রণয়ন করেন এবং হানিফ এটা টাইপ করে। কারণ হানিফ অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল, কোনোদিন তার কাছ থেকে একটি শব্দও বের করতে পারেনি। সেই ছয় দফা আসলে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ, আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি।

প্রধানমন্ত্রী জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশ ইনসুরেন্স (জাতীয়করণ) আদেশ-১৯৭২ জারি করে ৪৯টি দেশি-বিদেশি বিমা কোম্পানিকে জাতীয়করণ করে সুরমা, রূপসা, তিস্তা এবং কর্ণফুলি নামে চারটি বিমা করপোরেশন গঠন করেছিলেন। একইসঙ্গে এই চারটি প্রতিষ্ঠানকে দেখভাল করতে জাতীয় বিমা করপোরেশন গঠন করেন।

শিক্ষা বিমা: পৃথিবীর সব দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা বিমা আছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পিতা-মাতা বা অভিভাবকের অকাল মৃত্যুতে বা শারীরিক অক্ষমতায় তাদের শিক্ষাজীবন যাতে ব্যাহত না হয় সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বিমা চালু করা হয়েছে। দেশেও এ বিমার চালুর তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেমন একটা সন্তান জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি এ ধরনের একটা ব্যবস্থা করা যায়, একটা বিমা বাবা-মা করে রাখবেন, শিক্ষা বিমা। সেই সন্তান যখন বড় হবে, হয়তো প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে অতটা লাগবে না। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তার লাগবে। তাহলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার আর কোনো সমস্যা হবে না। ওই বিমার টাকা দিয়ে ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে পারবে। এদিকে আরেকটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

সার্বজনীন পেনশন: দেশের মানুষের জীবনের নিশ্চয়তায় সার্বজনীন পেনশন প্রবর্তন করা হচ্ছে বলেও জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা একটি ঘোষণা দিয়েছি, আপনারা জানেন যে আমরা সার্বজনীন একটি পেনশনের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। আসলে আমাদের ছোট দেশ, বিশাল জনসংখ্যা। এ জনসংখ্যার জন্য একটি সুরক্ষিত জীবন দেয়া। আমি চাই এদেশে কোনো মানুষ দরিদ্র থাকবে না, হতদরিদ্র থাকবে না। প্রত্যেকের জীবন জীবিকা চালুর মতো একটা সুন্দর ব্যবস্থা আমাদের সমাজে হবে, অর্থনৈতিকভাবে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রতিটি পরিকল্পনা নিচ্ছি কাজ করে যাচ্ছি এবং তার সুফল মানুষ পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পর সেটা ধরে রেখে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার সেটা আমরা করে দিচ্ছি।

সভাপতির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিমা কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ এখন ৬০ হাজার কোটি টাকা। দেশের সম্পদের পরিমাণের তুলনায় এখনো টাকা অনেক কম উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সম্পদ বাড়ানোর অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে  বাড়ি-গাড়ি, রেল, বাস-টার্মিনাল, রাস্তা-ঘাট এবং যাত্রীসহ নানা ধরনের বিমা চালু করার সুযোগ রয়েছে। এগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সব মানুষ ও সম্পদকে বিমার আওতায় আনতে হবে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশ যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই গতিতে বীমা খাত এগিয়ে নিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসময় তিনি বীমা খাতের উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরেন।

অর্থসূচক/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.