বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অপ্রয়োজনীয় ও অমূলক তথ্যে বিশ্বাস করবেন না। এসবে বিশ্বাস করে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে সজাগ থাকার জন্য বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দেন তিনি।
সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর হোটেল পূর্বাণীতে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) এবং বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটি মার্কেটের (বিএএসএম) যৌথ উদ্যোগে ‘ইকোনমিক পলিসি ট্রাইএঙ্গেল: ইন্টার রিলেশনশিপ অ্যামং, ফিসক্যাল, মনিটরি অ্যান্ড ক্যাপিটাল মার্কেট পলিসিস’ শীর্ষক কর্মশালায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ এ কথা বলেন।
বিএএসএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ, বিএসইসির সাবেক কমিশনার আরিফ খান, সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মাদ হেলাল উদ্দিন, বিআইবিএমের অধ্যাপক ড. শাহ মোহাম্মদ আহসান হাবীব এবং সিএমজেএফ সভাপতি জিয়াউর রহমান।
ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ইস্যু করে একটি গোষ্ঠি বাজারে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এর মাধ্যমে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বর্তমান কমিশন তা কখনো হতে দেবে না। যারা-ই এর সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাইকে খুঁজে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখার জন্য বর্তমান কমিশন সর্বাত্মক সচেষ্ট রয়েছে। মার্কেটের বা বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করে এমন কোনোকিছু এই কমিশন কখনোই হতে দিবেনা। সম্প্রতি বাজারে যে ধরনের দরপতন হয়েছে এর পেছনে প্রকৃত কারণ খুঁজতে মাঠে নেমেছে কমিশন।
নেগেটিভ ইক্যুইটি সংক্রান্ত জটিলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০২০ সালে এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে সঞ্চিতি না রাখলেও চলবে। এরপর আর কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি, নতুন কোনো সিদ্ধান্তও নেয়নি বিএসইসি। তাই পুরনো এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ভীতি ছড়ানোর বিষয়টি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ব্যাংকের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এক সময় পুঁজির যোগানে ব্যাংকের বাইরে কোনো বিকল্প উৎস ছিল না। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আর্থিক কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। এখন দেশের পুঁজিবাজার শিল্প-বাণিজ্যের অর্থায়নে অনেক ভূমিকা রাখতে পারে। তাই দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে ব্যাংকের উপর নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে পুঁজিবাজারবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং সেক্টর যে জায়গাটিতে ভূমিকা রাখার কথা সেই জায়গাটিতেই যদি রাখে তাহলে পুঁজিবাজারসহ সার্বিক অর্থনীতি লাভবান হবে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে এনবিআর কমিশন পুঁজিবাজারের কমিশনের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করার প্রত্যয় দিয়েছে।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআর- এই ৩ টি প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করলে দেশের অর্থনীতি আরো লাভবান হবে। তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আরো সংযোগ বাড়াতে হবে।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ইউনিলিভার, মেটলাইফ ও নেসলেসহ দেশি-বিদেশি বড় বড় শতাধিক কোম্পানি এখনো পুঁজিবাজারের বাইরে। এসব কোম্পানিকে বাজারে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে এনবিআরকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্থ হবে, এটা ভেবে এসব প্রতিষ্ঠানকে কিছু বলা যাবে না- এটা ভুল চিন্তা। হয় এসব প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে অথবা তাদেও উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করতে হবে।
তিনি বলেন, ভালো কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে পর্যাপ্ত আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে বড় বড় লাভজনক কোম্পানিকে বাজারে আনা গেলে পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়বে, বিনিয়োগকারীসহ স্টেকহোল্ডাররা লাভবান হবেন; অন্যদিকে সরকারেরও রাজস্ব আয় বাড়বে।
তিনি আরো বলেন, সুদের হার কমলে পুঁজিবাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ে- এটা মনিটারি পলিসির বিষয়। পুঁজিবাজারের গতি বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটারি পলিসি এবং এনবিআরের করের বিষয়গুলো ঠিক করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ড. মোহাম্মাদ হেলাল উদ্দিন বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই ভুল নীতির কারণে বুদ্বুদ তৈরি হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশেও বুদ্বুদ ও ধস তৈরি হয়েছিল ভুল পলিসির কারণে। সম্ভবত এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালার ক্ষেত্রে অতিরক্ষণশীল অবস্থানে থাকে, পুঁজিবাজারে সূচক একটু বাড়লেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বাস্তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। বাজারে বেশিরভাগ শেয়ারের মূল্য এখনো যৌক্তিক পর্যায়ের নিচে। গত এক দশকের মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য বিষয় সমন্বয় করা হলে সূচক এমনিতেই সাড়ে ৭ হাজার থাকার কথা, দৈনিক গড় লেনদেন হওয়ার কথা ৩ হাজার কোটি টাকার উপরে।
আরিফ খান বলেন, পুঁজিবাজারসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা এবং এসব নীতিমালা প্রণয়নে যুক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরী। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এসব সংস্থার অনেকেই এই সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না।
তিনি বলেন, গত ৩০ বছরে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ৯৯ শতাংশ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে এসে লোকসান দিয়েছেন। এর কারণ তাদের বড় অংশ পুঁজিবাজার সম্পর্কে না জেনে, না বুঝে বিনিয়োগ করেন। হুজুগে ও গুজবে বিশ্বাস করে শেয়ার কেনেন, কোম্পানির মৌলভিত্তি না দেখে আইটেম খুঁজেন।
একই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে মুনাফা করতে হলে লোভ ও ভয়-দুটোকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
অধ্যাপক ড. শাহ মোহাম্মদ আহসান হাবীব বলেন, আমাদের দেশে একটা শক্তিশালি পুঁজিবাজার দরকার। কিন্তু তা হচ্ছে না। অথচ বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনৈতিক অনেক পিলার থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে মাত্র একটি পিলার। তা হলো ব্যাংকিং খাত। তিনি ব্যাংকের বিকল্প পিলার হিসেবে পুঁজিবাজারকে তৈরির করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, বাজারের অবস্থা খারাপ হলে অনেককেই দোষারোপ করা হয়। কিন্তু কখনোই বিনিয়োগকারীদের দোষারোপ করা হয় না। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোন দোষ নেই- এমন ভাবনাই ঠিক না। না জেনে, না বুঝে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা যায় না, পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ স্বল্প সময়ের জন্য নয়, দীর্ঘ সময়ের জন্য- এই বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীদের বুঝাতে হবে। পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারী হিসেবে দেশের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করা যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিদেশে বেশি বেশি প্রচার করছেন। এটা ভালো তবে আগে দেশের মানুষকে এই বাজার সর্ম্পকে শিক্ষিত ও সচেতন করতে হবে। আরো বেশি বেশি মানুষকে এই বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
জিয়াউর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা নিশ্চিতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অর্থসূচক/এমআরএম/এমএস/এমএস



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.