পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলিত অর্থ ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যয় করবে কৃষিবিদ সিড

একান্ত সাক্ষাতকারে এমডি আলী আফজাল

কোয়ালিফাইড ইনভেস্টরস অফার (কিউআইও) এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসছে কৃষিবিদ সিড লিমিটেড। বাজার থেকে কোম্পানিটি ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করবে। সফলভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে এসএমই তথা ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলোর জন্য গঠিত স্মলক্যাপ বোর্ডে তালিকাভুক্ত হবে কোম্পানিটি। এটি হবে দেশের স্মলক্যাপ বোর্ডে তালিকাভুক্ত একটি শিল্প গ্রুপের দ্বিতীয় কোম্পানি।

কিউআইকে সামনে রেখে অর্থসূচককে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে কোম্পানির নানা দিক সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন কৃষিবিদ গ্রুপের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এবং কৃষিবিদ সিডের চেয়ারম্যান ড. আলী আফজাল

কৃষিবিদ সিড কি ধরনের পণ্য বাজারজাত বা বিক্রি করে থাকে? এই কোম্পানির বার্ষিক পণ্য বিক্রির পরিমাণ কত?

কৃষিবিদ সিড কৃষিবিদ গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সুনামধন্য ছয় হাজার পাঁচশতজন কৃষিবিদ এবং কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কৃষিবিদ গ্রুপ। কৃষিবিদ গ্রুপের অধীন মোট ২৯ টি কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে কৃষিবিদ সিড একটি। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ যার উন্নতি এবং অগ্রগতি অনেকটাই কৃষির উপর নির্ভরর্শীল। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের অনেক খাতেরই উন্নয়ন হয়েছে যার মাঝে সবথেকে বেশি উন্নয়ন হয়েছে কৃষি খাতের। কৃষিখাতের একটি উপখাত হচ্ছে শস্যখাত যার অন্যতম উপাদান হচ্ছে বীজ। আপনি ধান, পাট, সবজি কিংবা ফলমূল যাই চাষ করেন না কেন, বীজ যদি মানসম্মত না হয় তবে চাষি যতোই চেষ্টা করুক, ভালো ফলন কিন্তু আশা করা যায় না। তাই বীজ নিঃসন্দেহে কৃষিখাত এবং কৃষকের উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর কৃষিবিদ সিড সেই ব্যাবসাটিই করে থাকে। আমাদের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৩০ কোটি টাকার মতো। তবে আমরা আমাদের এই বীজের ব্যাবসাটিকে ধীরে ধীরে সম্প্রসারণের বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছি।

বিক্রিত পণ্যের কত শতাংশ আপনারা দেশে উৎপাদন করে থাকেন?

ভালো বীজ মানেই হচ্ছে ভালো ফসল। এই বীজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে উন্নত জাত। কৃষিবিদ সিডের নিজস্ব আরএনডি বা গবেষণাগার রয়েছে। যে গবেষণার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন মাঠ-ফসলের প্রায় ৬৬ রকমের উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছি। আর সে সকল উন্নত জাতের বীজই আমরা মাঠ পর্যায়ে দিয়ে থাকি, যা কৃষকরা পেয়ে থাকেন।

উচ্চফলনশীল যাতের ফসলের বীজ পুরোটাই আমরা দেশে উৎপাদন করে থাকি। এছাড়াও হাইব্রিড জাতের বীজের একটা বড় অংশ বা ৮০ শতাংশ আমরা দেশে উৎপাদন করে থাকি। ২০ শতাংশ আমরা আমদানি করে থাকি।

দেশে বীজের বাজারের আকার কত বড়? এখানে আপনাদের কোম্পানির অংশ কতটুকু?

বাংলাদেশের বীজের বাজারে অনেকেই ব্যবসা করে থাকে। বড়-বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, দেশীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অনেকেই সিডের ব্যবসা করছে। সিডের এই ব্যবসায় আজ থেকে ৪০ বছর আগে বড় কোনো কর্পোরেট হাউজ কিংবা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ছিল না। দেশের চাষিরাই বীজ সংরক্ষণ করতো, আবার তারাই মাটির পাত্রে করে বীজ বিক্রয় করতো। সময়ের ব্যবধানে এ ব্যবসায় বড় বড় প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে এবং ব্যবসার উন্নতি হয়েছে। দেশে সিডের মার্কেট বা বীজের বাজারের আকার এখন অনেক বড় । এই বাজারের আমাদের অংশ ২ থেকে ৩ শতাংশের মতো। তবে আশা করছি খুব সহসাই আমরা এ ব্যাবসার সম্প্রসারণ করে বাজারের ৫ থেকে ৬ শতাংশ চাহিদা পুরণে  সফল হবো।

দেশে বীজের বাজারের আকার কী হারে বাড়ছে? আগামী দিনে এই খাতের সম্ভাবনা কতটুকু?

সিডের এই ব্যবসায় আজ থেকে ৪০ বছর আগে বড় কোন কর্পোরেটহাউজ কিংবা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ছিল না। দেশের চাষিরাই বীজ সংরক্ষণ করতো আবার তারাই মাটির পাত্রে করে বীজ বিক্রয় করতো। সময়ের ব্যবধানে এ ব্যাবসায় বড় বড় প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে এবং ব্যবসার উন্নতি হয়েছে। দেশে বীজের বাজারের আকার এখন অনেক বড়। প্রতিবছরই এই বাজারের আকার বাড়ছে।

আগামী দিনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং বাজারে নিজেদের অংশ বাড়াতে কি প্রস্তুতি আছে আপনাদের?

আমরা আমাদের এই বীজের ব্যাবসাটিকে ধীরে ধীরে সম্প্রসারণের বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছি। তবে সিড ব্যাবসা এমন এক ব্যবসা যা চাইলে-ই রাতারাতি বড় করা সম্ভব নয়। আগে প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে হবে, তারপর এই ইন্ডাস্ট্রি বড় করতে হবে। আর আমাদের ব্যবসাও খুব বেশি দিনের নয়, ২০১৬ সালে আমরা যাত্রা শুরু করেছি। এখন আমরা যেহেতু ভ্যারাইটি হাতে পেয়েছি, এখন আশা করছি সহসাই খুব বড় করতে পারবো। এজন্যই আমরা পুঁজিবাজারের এসেছি, বাজার থেকে কিছু বিনিয়োগ পেলে আমরা এ ব্যবসার সম্প্রসারণ করবো। আশা করি দেশের বীজ বাজারের ৫ থেকে ৬ শতাংশের চাহিদা আমরা পুরণ করবো। বার্ষিক টার্নওভার ৩০ কোটি থেকে ১০০ কোটিতে চলে যাবে বলে আমরা মনে করি।

দেশের অর্থনীতিতে এই খাতের গুরুত্ব কতোটুকু?

কৃষিখাত দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। যার উপরে দেশের ১৮ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা নির্ভরশীল। আমাদের ছোট্ট একটি দেশ যার জনসংখ্যা ১৮ কোটি। ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির কারণে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হলেন লকডাউন দিতে, তখন উনি বলেছিলেন ১ ইঞ্চি যায়গাও যেন ফাঁকা না থাকে। বাংলার চাষীরা কথা রেখেছে। সম্মুখসারির যোদ্ধা বলা হয় ডাক্তারদের, আমিতো বলি, সম্মুখসারির যোদ্ধা হচ্ছেন কৃষকরা। এই করোনা মহামারির মাঝেও বাংলার দেড় কোটি কৃষকের ১ জনও ঘরে ছিলেন না; সবাই মাঠে কাজ করেছে। যার ফলে সারা বিশ্বের মাঝে বাংলাদেশে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতেও সর্বোচ্চ ধানের উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু এই উৎপাদন কৃষক করলেও তার যে ফসলের বীজ সেটা কে দিয়েছে? সেটার যোগান দিয়েছি আমরা। কৃষিবিদ ফিড সহ অন্যান্য প্রাইভেট বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তারাই এই বীজের যোগান দিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোই কৃষকদের সাথে মাঠে থেকে বীজ সরবরাহ করেছে, প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে যার ফলে দেশে ফসলের এতো বড় উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। দেশে খাদ্যের যোগান স্বাভাবিক রাখতে হলে এই খাতের গুরুত্ব অপরিসীম।

বীজের ব্যবসা কোনো ধরনের সমস্যা আছে কি? থাকলে এই সমস্যা উত্তরণে কী করণীয়?

ব্যবসা সহজিকরণ যে সূচক রয়েছে তাতে আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে। একটা ব্যবসা যখন একজন ব্যবসায়ী করেন ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে ট্যাক্স-ভ্যাট সব ক্ষেত্রেই সরকারি সংস্থার সাথে কাজ করতে হয়। সেই যায়গায় সরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা আরও সহজলভ্য এবং স্বচ্ছতা আরও বাড়ানো দরকার। তবেই দেশে নতুন উদ্যোক্তা বৃদ্ধি পাবে।

নিঃসন্দেহে যে কোনো দেশেই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কৃষিখাতের প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে সরকারের তরফ থেকে কৃষিখাতে যথেষ্ট পরিমাণে ভর্তুকি দেয়া হয়। আবার এই বিশ্বমোড়লরাই কৃষিখাতে ভর্তুকি দিতে না করে। আমার মতে কৃষিখাতে ভর্তুকি দিতে হবে, কৃষক কে ন্যায্যমূল্য দিতেই হবে।

পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলিত ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা কোম্পানির ব্যবসার উন্নয়নে কীভাবে কাজে লাগবে?

বীজ ব্যাবসার মূল কাজই হচ্ছে গবেষণা করে নতুন জাত উদ্ভাবন, উন্নত জাতের বীজ উৎপাদন এবং সেই বীজকে সংরক্ষণ। কারণ উৎপাদনের সাথে সাথেই সেই বীজ ব্যাবহারযোগ্য হয়ে যায় না। অনেক রকমের প্রক্রিয়ার পর সেই বীজ চাষাবাদের উপযোগী হয়ে ওঠে। সে সময়টুকু আমাদের বীজগুলো সংরক্ষণ করতে হয়।

তাই এই উত্তোলিত অর্থ বিনিয়োগের জায়গা হচ্ছে তিনটি- আরএনডিতে বা গবেষণা, বীজ উৎপাদনেএবং সংরক্ষণ। সারাদেশে আমরা মোট তিনটি ওয়্যারহাউজ করতে যাচ্ছি। একটি হবে মাগুরায়, যা দক্ষিণাঞ্চলের বীজের যোগানে সহায়তা করবে, আরেকটি হবে দিনাজপুরে, যেটি উত্তরবঙ্গের এলাকাগুলোর জন্য বীজ উৎপাদন করবে এবং আরেকটি হবে সাভারে, যেখানে আমাদের মুল গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত কাজ আমরা সম্পাদন করবো। পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলিত অর্থ দিয়ে এই পুরো প্ল্যানটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আমরা ওই টাকার সাথে আরও টাকা যোগ করে আমাদের এঈ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।

 ইতোমধ্যে পুঁজিবাজারে স্মলক্যাপ বোর্ডে কৃষিবিদ গ্রুপের একটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই বিষয়ে আপনাদের অভিজ্ঞতা ও মূল্যায়ন কী?

এসএমই প্ল্যাটফর্মকে পুঁজিবাজারে সংযুক্ত করার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম স্যারকে। এসএমই আসলেই বাজারের জন্য খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। তবে প্রতিটি ভালো উদ্যোগের পেছনেই কিছু জটিলতা থাকে, সেই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে সেই উদ্যোগটি সফলতা বয়ে আনতে পারেনা। স্মলক্যাপ করার মূল লক্ষই হলো ছোট ছোট বিনিয়োগ সহজ করা, ছোট ছোট পুঁজির মানুষগুলোকে এখানে সম্পৃক্ত করা। কিন্ত এখানে ছোট পুঁজির বিনিয়োগকারীরা বাধাগ্রস্ত কারণ এখানে যারা শেয়ার কিনবেন তাদের কোয়ালিফাই হতে হবে। মূল মার্কেটে ৫০ লাখ টাকার শেয়ারে বিনিয়োগ না থাকলে তিনি এলিজিবল বা স্মলক্যাপ বোর্ডের জন্য যোগ্য না। অন্যদিকে, যারা শেয়ার কিনেন তারা ব্যাবসা করতে আসেন, যে শেয়ার কিনলে সে বিক্রি করতে পারবে না বা বিক্রেতা পাবেন না সেরকম শেয়ারে তো ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। তাই সে জায়গার থেকে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় যে ছোট এই স্মলক্যাপ মার্কেটের জন্য এই শর্ত প্রযোজ্য না, এটা তুলে দেয়া উচিৎ। কমিশনের অনেকের সাথে আমার কথা হয়েছে এই বিষয়ে, তারা আমাকে বলেছেন বিষয়টি তারা সহজ করবেন। আমার মনেহয় যে মূল মার্কেটের মতো স্মলক্যাপেও বিনিয়োগ উন্মুক্ত হলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আরও আগ্রহী হবেন এবং এই উদ্যোগটি সফল হবে।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.