টাকা পাচার রোধে কঠোর আইন করার পরামর্শ ইআরএফের

দেশ থেকে টাকা পাচার রোধে কঠোর আইন করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আহ্বান জানিয়েছে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-ইআরএফ। মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এনবিআর সম্মেলন কক্ষে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এই প্রস্তাবসহ মোট ২০ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে ঢাকায় কর্মরত অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের এই সংগঠন।

আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভী ও সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম। এসময় ইআরএফের অন্য নেতারা বক্তব্য রাখেন।

টাকা পাচার বন্ধে কঠোর আইন সংক্রান্ত প্রস্তাবে ইআরএফ বলেছে, দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমান টাকা পাচার হচ্ছে। এই পাচার রোধে ২০১৩ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে একটি আইন করা হয়েছিল। বাস্তবে এর অগ্রগতি কতটুকু সেটা দেশবাসী জানে না। বর্তমান বাস্তবতায় মুদ্রা পাচার রোধে ভারত অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কঠোর আইন করা এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রস্তাবনার শুরুতে ইআরএফ বলেছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রফতানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অনেক দেশের সঙ্গেই এফটিএ বা পিটিএ’র মত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হবে। সে কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে। এক্ষেত্রে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শুল্ক আদায় তথা রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার ধাক্কা মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

আয়কর সংক্রান্ত প্রস্তাব

১. এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, দেশে ইটিআইনধারীর সংখ্যা ৭০ লাখের মত। এর মধ্যে আয়রক রিটার্ন দাখিল করেন ২৪ থেকে ২৫ লাখ। অথচ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। রিটার্ন দাখিল না করা এ বিপুল পরিমাণ টিআইএনধারীকে কর নেটের আওতায় আনতে আইনের বাধ্যবাধতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতনা করা দরকার।

২. সিটি করপোরেশন এলাকার নাগরিকদের সর্বনিম্ন কর ৫ হাজার টাকা। করের এ পরিমাণটি কমিয়ে সব টিআইএনধারীকে কর প্রদানে উৎসাহী করতে হবে।

৩. দেশের অর্থনীতির পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দশ বছরে বিপুল সংখ্যক মানুষ কর প্রদানে সামর্থ্যবান হয়েছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, এই মূহুর্তে দেশে করযোগ্য মানুষ অন্তত ২ কোটি। আবার কেউ বলছেন, এই সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। করযোগ্য নাগরিকদের সংখ্যা নিয়ে এই বিভ্রান্তি দূর করতে কিংবা দেশে করযোগ্য প্রকৃত নাগরিকের সংখ্যা নিরুপণে এনবিআরের একটি ব্যাপকভিত্তিক জরিপ চালানো জরুরি। একইসঙ্গে তাদেরকে করের আওতায় আনতে সারাদেশের উপজেলা পর্যায়ে এনবিআরের কার্যক্রম বাড়ানো দরকার।

৪. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জাতীয় সংসদে বলেছেন, বাংলাদেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। কিন্তু এনবিআরে আয়কর জমা দেন মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার বিদেশী নাগরিক। দেশে কর্মরত বিদেশীরা বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায় বলে এক গবেষণায় জানিয়েছে টিআইবি। বিদেশি নাগরিকদের করের আওতায় আনতে এনবিআারের উদ্যোগ আরও জোরালো করার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

৫. বর্তমান আইন অনুযায়ী কাঁচামাল বা পণ্য আমদানির সময় ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে উৎসে কর কাটা হয়। এটি পরবর্তীতে সমন্বয় করে এনবিআর। তবে পণ্য বিক্রি করে কর সমন্বয়ের আগ পর্যন্ত ব্যবসায়ীর বড় আকারের মূলধন আটকে যায়। আমরা কর আদায়ের বিরোধিতা করছি না। তবে এভাবে ব্যবসার মূলধন আটকে না রেখে অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে কর আহরণ করা যায় কি না, তা ভাবতে অনুরোধ করছি। একইসঙ্গে কোনো ব্যবসায়ী যেনো কর ফাঁকি দিতে না পারেন সেজন্য এনবিআরের অটোমেশন ও কঠোর মনিটরিংয়ের সুপারিশ করছি।

৬. অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল পদ্ধতিকে আরও জনপ্রিয় করতে ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা চালানো দরকার।

৭. রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটটি আপগ্রেড করার প্রস্তাব করছি। এতে অনেক হালনাগাদ তথ্য ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। একইসাথে বোর্ডের গবেষণা সেলটি আরও কার্যকর ও যুগোপযোগি করার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। একজন সদস্যের নেতৃত্বে গবেষনা ও পরিসংখ্যান বিভাগকে শক্তিশালী করা যেতে পারে।

৮. দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমান টাকা পাচার হচ্ছে, এই পাচার রোধে ২০১৩ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে একটি আইন করা হয়েছিল। বাস্তবে এর অগ্রগতি কতটুকু সেটা আমরা জানি না। মুদ্রা পাচার রোধে ভারত অথবা দক্ষিন কোরিয়ার মত কঠোর আইন করা যায় কি-না সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।

৯. বিনিয়োগকারিদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কর কাঠামো প্রনয়ণ করা যেতে পারে। এটি হলে উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারবেন।

১০. আমরা জানি আয়কর নিয়ে একটি আইন হচ্ছে। এ আইনটি আধুনিক এবং সহজবোধ্য ভাষায় হচ্ছে। তবে আইনটির খসড়া হওয়ার পরপরই দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার। আইনটি বাস্তবায়নের আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসে তাদের মতামতের ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত করার অনুরোধ করছি।

১১. কাঠামোগত সমস্যা বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। এ দূর্বলতা কাটিয়ে কাঙ্খিত রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পুর্নগঠন জরুরি। ভারতের মত ডাইরেক্ট ট্যাক্স এবং ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স নামে দুটি বিভাগ গঠন করা যেতে পারে। দুই বিভাগে দুইজন সচিব নিয়োগ করা হবে। অথবা একটি রেভিনিউ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এর একজন প্রধান কমিশনার থাকবেন, যার অধীনে অন্য কমিশনাররা থাকবেন। সরকার তাদের নিয়োগ দেবে।

ভ্যাট ও কাস্টমস সংক্রান্ত প্রস্তাব

১২. বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে এনবিআর আইনি কাঠামোয় পরিবর্তনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এ খাতে অনিয়ম রোধ এবং আরও রপ্তানিবান্ধব বন্ড ব্যবস্থাপনা তৈরির জন্য এনবিআরের নেয়া বন্ডেড ওয়্যারহাউজ অটোমেশন প্রকল্পের কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে পুরো প্রক্রিয়াকে অটোমেশনের আওতায় আনা দরকার।

১৩. এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের সমন্বয়ে একটি ট্যারিফ কমিশন পলিসি করা হয়েছে। তবে ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষমতা শুধু এনবিআরের। কোন খাতের জন্য ট্যারিফ কেমন হবে, কিভাবে রেশনালাইজ করা উচিত তা আউট লাইন করা রয়েছে ওই পলিসিতে। স্থানীয় শিল্পের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে কি কি সুবিধা দেয়া উচিত তা নির্ধারণ করে ট্যারিফ পলিসিটি দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করছি।

১৪. রপ্তানিতে তৈরি পোশাক শিল্পের সফলতা অসামান্য। এর পেছনে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ডেড সুবিধাসহ নানা ট্যারিফ সুবিধা। রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্য সম্ভাবনাময় খাত যেনো তৈরি পোশাক শিল্পের মতো নিয়মিত বন্ডেড সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

১৫. একই এইচ এস কোড এ মাল্টিপল ট্যারিফ রয়েছে। এক ট্যারিফের পণ্য অন্য পণ্যের এইচ এস কোডে আমদানি করতে গেলে ব্যবসায়ীরা অনেকক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। অনেক সময় শুল্ক কর্তৃপক্ষের স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়। প্রতিটি পণ্যের জন্যই আলাদা এইচ এইচ কোড নির্ধারণ প্রয়োজন।

১৬. ব্যবসায় পরিবেশ সহজ করা এবং এনবিআরের কার্যক্রমকে অটোমেশন করতে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো করার উদ্যোগ রয়েছে এনবিআরের। ২০২২ সালে এটির উদ্বোধন হওয়ার কথা। আমরা প্রত্যাশা করবো এ কাজটি যেনো নির্ধারিত সময়েই শেষ হয়।

১৭. বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, সারাদেশে খুচরা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বড় অংশই কমপ্ল্যায়ন্ট নয়। স্বভাবতই তাদের বড় অংশ ভ্যাট দেয় না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভ্যাটের আওতায় আনার সুপারিশ করছি। পাশাপাশি খুচরা ব্যবসায়ীদের ভ্যাট, পণ্য মূল্যের ওপর নির্ধারণ না করে সংযোজিত মূল্যের ওপর নির্ধারণ করা দরকার। কারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা ভ্যাট রিফান্ড পান না।

১৮. ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে ইএফডির ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

১৯. পরিবেশবান্ধব বা সবুজ শিল্পায়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এনবিআর সাধারন কারখানা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পের মধ্যে কর্পোরেট করের ব্যবধান কমপক্ষে ৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব কারখানায় অতিরিক্ত বিনিয়োগের তুলনায় বিদ্যমান ২ শতাংশ কর সুবিধা অপ্রতুল বলে মনে করছে অনেকে।

২০. করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে বোতলজাত পানির উপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক শিথিল করা যায় কি-না সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে।

সবশেষে, জেলা শহরের বাইরে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উৎসাহ প্রদানে ওই বিনিয়োগকে করমুক্ত সুবিধা দেয়ার সুপারিশ করছে ইআরএফ। পাশাপাশি ডিজিটাল অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটায় এই খাতকে করের আওতায় আনারও সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।

অর্থসূচক/এমএস