শিশু-কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোন: নিয়ন্ত্রণ জরুরি

আমি একজন অভিভাবক হিসাবে খুবই উদ্বিগ্ন যে, আমার ছেলে-মেয়ের হাতে প্রয়োজনে মোবাইল নামক ডিভাইসটি দিতে হচ্ছে। কিন্তু আমি তা ব্যবহারের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না। উন্নত বিশ্বসহ সারা বিশ্বে শিশুদের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মা-বাবা বা অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। International Telecommunication Union (ITU) ২০০৮ সালের নভেম্বরে Child Online Protection (COP) শিশুদের সাইবার অপরাধ থেকে সুরক্ষার জন্য এই নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত করে।

এই নীতিমালা উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা তাদের টেলিকম অপারেটরদের উপর প্রবর্তিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- যুক্তরাষ্টের Federal Communication Commission (FCC) তাদের সবগুলো টেলিকম অপারেটরের উপর অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, চায়না, সাউথ আফ্রিকা, অট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে শিশুদের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহারের উপর অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মূলতঃ অভিভাবকরা ১৮ বছরের নিচের ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল তুলে দেন নিরাপত্তা ও যোগাযোগের জন্য। যা ব্যস্ততম জীবনে অনেকটা অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে।

কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে ‘স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭ শতাংশ পর্নোগ্রাফি দেখে। বাণিজ্যিকভাবে তৈরি পর্নোগ্রাফির চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে তৈরি পর্নো ভিডিও মানুষ বেশি দেখছে। বেশি ভাগ ক্ষেত্রে দেশে তৈরি এই পর্নোগ্রাফিগুলোতে যাদের ভিডিও দেখানো হচ্ছে, তাদের বয়স ১৮-এর কম। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবেই পর্নোগ্রাফির ঝুঁকি বাড়ছে। ঢাকার ৫০০ স্কুরগামী শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৭৭ শতাংশ শিশু নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখছে। তারা সুস্থ যৌনশিক্ষার বিপরীতে বিকৃত যৌনশিক্ষার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে।

সমীক্ষাটি করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামক একটি সংস্থা। আমরা জানি যে, কোনো জরিপ বা সমীক্ষা হয়তো শতভাগ নির্ভুল নয়। এ ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির প্রকৃত হার হয়তো ৫-৭ শতাংশ কম-বেশী হতে পারে। কিন্তু শিশু-কিশোরদের মধ্যে যে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আর এটি-ই উদ্বেগের বিষয়। কারণ স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি এভাবে ছড়িয়ে পড়া যে জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার চেয়ে কম ভয়াবহ নয়।

উল্লেখিত গবেষণা সমীক্ষায় আরও উল্লেখ করা হয়, ‘চারটি পদ্ধতিতে অশ্লীল ভিডিও তৈরি হচ্ছে। তাতে ১৮ বছরের কম বয়সী স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দেখা যাচ্ছে। ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন ধরনের পর্নো ভিডিও তৈরি করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তরুণ-তরুণী কেউই জানে না, তৃতীয় কোনো ব্যক্তি লুকিয়ে ভিডিও করছে। মোবাইল ফোনের সঙ্গে ভিডিও রেকর্ডিং সুবিধা থাকায় এ ধরনের পর্নো ভিডিও তৈরি হচ্ছে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিওগুলোতে দেখা যায় বেশীরভাগ কিশোর-কিশোরীরা যৌন উত্তেজক ভিডিও আপলোড করছে, এগুলোর বেশীরভাগ সাইবার অপরাধ পর্যায়ে পড়ে। স্কুলগামী এই শিশু/কিশোর-কিশোরীদের দেখলেই বোঝা যায় এরা মোবাইল যন্ত্রটির ডাটা ইন্টারনেট ব্যবহার করে কি করছে ! তারা বিকৃত যৌনতা ও সহিংসতা শিখছে এবং অনেকক্ষেত্রে নিজেরা তা করতে গিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলোর এক উপ-সম্পাদকীয়তে লেখেন-‘মেধাকে তারা সৃষ্টিশীল ও মানবকল্যাণে ব্যবহার না করে জিঘাংসা ও ক্ষতিকর কাজে লাগাচ্ছে। সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের দায়িত্ব, তারা যাতে সেই পথে যেতে না পারে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ দায়িত্ব সরকার ও নাগরিক সমাজ দু’দিকেরই।’

অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ ((Parental Control)):
এটি একটি সফটওয়ার ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার tools এর সমন্বয়- যা পিতামাতা ও অভিভাবকদের সাহায্য করে তাদের ছেলে-মেয়েদের মোবাইল ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে। এবং তা নিশ্চিত করবে রেগুলেটরী কমিশন মোবাইল সেবাদাতাদের উপর। মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এটা তিনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ১. Usages Control, ২. Content Filtering এবং ৩. Location and Monitoring Setting. মূলত বাংলাদেশের জন্য এখনই প্রয়োজন Usages Control । অপারেটরগুলোর যে সেবা রয়েছে সেগুলো মূলত ৪ ধরনের: 1. Voice, 2. SMS, 3. MMS 4. Data। যে কোনো অভিভাবক চাইলে তাদের শিশুদের জন্য শুধু Voice এবং SMS নিতে পারবেন এবং বাকি দুটি সার্ভিস বন্ধ রাখতে পারবেন। এটা মূলত নিশ্চিত করবে অপারেটরগুলো। আর এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং নতুন প্রজন্মকে সাইবার অপরাধ থেকে রক্ষার জন্য মোবাইল ব্যবহারের উপর অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণ বা Parental Control নিশ্চিত করতে হবে এখনই ।

লেখক: মক্তবুর রহমান। সিইও, গ্লোবাল ফেয়ার কমিউনিকেশন লিমিটেড

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.