এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে সচল গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা

এখনো সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের শাখা নেই। এরপরও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ পাচ্ছেন ব্যাংকিং সেবা। করোনাকালীন সময়ে পরিচালন ব্যয় কমাতে বর্তমানে ব্যাংকগুলো শাখার পরিবর্তে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো বিকল্প সেবার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। এতে গ্রামীণ জনগণ আরো বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হচ্ছেন। ফলে দ্রুতগতিতে সচল হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা।

দেশের সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দিতেই ২০১৪ সালে চালু হয় এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম। এজন্য বাড়তি চার্জও গুণতে হয় না গ্রাহককে। ব্যাংকের ডেবিট কার্ড ব্যবহারের সুযোগও পাচ্ছেন তারা। ফলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় এবং ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কম হওয়ায় এখন ব্যাংকগুলোও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। এতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গ্রাহক সংখ্যা, সেইসঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের এক কোটি ২২ লাখ পাঁচ হাজার ৩৫৮টি হিসাবের মধ্যে ৮৬ শতাংশই গ্রামের, বাকিটা শহরের অধিবাসীদের। চলতি বছরের জুন মাস শেষে এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। আর গত ২০২০ সালের জুন শেষে ছিল ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে আমানতের পরিমাণ ৯৯ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে দুই হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

একই সময়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণও বেড়েছে। গত বছরের (২০২০) জুন শেষে এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭২০ কোটি টাকা। আর গত জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১৮৬ কোটি টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বিতরণের হার বেড়েছে ৩৪২ দশমিক ২১ শতাংশ। আর তিন মাসের ব্যবধানে ২৭ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়েছে ঋণ বিতরণ।

জানা গেছে, করোনায় ব্যাংকের সব ধরনের আয় কমে গেছে। অন্যদিকে পরিচালন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। পরিচালন ব্যয় কমাতে এজেন্টের ওপর ভর করেই ব্যাংকিং সম্প্রসারণ করছে ব্যাংকগুলো। করোনায় ব্যাংক লেনদেন কমে যাওয়ায় আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে বেড়েছে পরিচালন ব্যয়। এই ব্যয় কমাতে ব্যাংকিং সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত এক বছরে ব্যাংকের মূল শাখা বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আর এজেন্ট ব্যাংকের শাখা বেড়েছে ৪৮ শতাংশের ওপরে।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে একদিকে কোনো খরচ ছাড়াই ব্যাংকের লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যাও বাড়ছে কোনো খরচ ছাড়াই। আর গ্রাহকরাও সহজেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সঠিকভাবে পরিচালনা করলে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। এছাড়া, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানতের অর্থে সিংহভাগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের সুযোগ করা গেলে তা গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে আরো শক্তিশালী ও সচল রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেন তারা।

এজেন্ট ব্যাংকিং বিষয়ে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী অর্থসূচককে বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রায় ৪০ লাখ এজেন্ট গ্রাহক রয়েছে। করোনাকালীন সময়ে গত এক বছরেই এজেন্ট গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ২৫ লাখ। এছাড়া বর্তমানে ব্যাংক এশিয়ার প্রায় চার হাজার ২৫০ এজেন্ট রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এজেন্টে ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি বলেন, গ্রাহকরা খুব সহজেই এজেন্টের মাধ্যমে তাদের আর্থিক লেনদেন করতে পারেন। এরজন্য তার সময় ও শ্রম দুটোই কম লাগে। তাছাড়া করোনার সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাহকরা শহরে ব্যাংকের শাখায় না গিয়ে তাদের আশেপাশের এজেন্টদের থেকে আর্থিক লেনদেন করতে পারতেন। তাই এই সময়ে তাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এজেন্ট ব্যাংকিং।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুন মাস সময় পর্যন্ত দেশের ২৩টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু করেছিল। আর চলতি বছরের জুন মাস শেষে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত হলো আরো ৫টি ব্যাংক। ফলে দেশে এখন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে ২৮টি ব্যাংক। শহরের চেয়ে গ্রামে এজেন্ট ব্যাংকিং বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এ সেবায় শীর্ষে অবস্থান করছে বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এরপরই রয়েছে ব্যাংক এশিয়া এবং ইসলামী ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো শুধু হিসাব খোলা/ পরিচালনা করা এবং রেমিটেন্স বিতরণের মধ্যেই সীমাবব্ধ নেই বরং, ঋণ বিতরণের মাধ্যমে আয় উপার্জনকারী কর্মকা-কে উৎসাহিত করে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারির পর ২০১৪ সালে প্রথম এ সেবা চালু করে বেসরকারি খাতের ব্যাংক এশিয়া।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শুধু টাকা উত্তোলন বা জমা হচ্ছে না। এর মাধ্যমে ঋণ বিতরণও হচ্ছে। গত বছরের জুন শেষে এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭২০ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১৮৬ কোটি টাকায়। ফলে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বিতরণের হার বেড়েছে ৩৪২ দশমিক ২১ শতাংশ। এর মধ্যে গত জুন শেষে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ঋণই গ্রামাঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নীতিমালা মেনেই কাজ করছে ব্যাংকগুলো।

আলোচ্য সময়ে এজেন্ট ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেড়েছে। গত বছরের জুন শেষে রেমিট্যান্স বিতরণ হয়েছিল ২৬ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের জুন শেষে বিতরণ হয়েছে ৬৭ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ।

প্রসঙ্গত, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, টাকা স্থানান্তর (দেশের ভেতর), রেমিট্যান্স উত্তোলন, বিভিন্ন মেয়াদি আমানত প্রকল্প চালু, ইউটিলিটি সার্ভিসের বিল পরিশোধ, বিভিন্ন প্রকার ঋণ উত্তোলন ও পরিশোধ এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সরকারি সব ধরনের ভর্তুকি গ্রহণ করা যায়। এজেন্টরা কোনো চেক বই বা ব্যাংক কার্ড ইস্যু করতে পারে না। এজেন্টরা বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত কোনো লেনদেনও করতে পারেন না। এ ছাড়া এজেন্টদের কাছ থেকে কোনো চেকও ভাঙানো যায় না। মোট লেনদেনের ওপর পাওয়া কমিশন থেকেই এজেন্টরা আয় করেন।

অর্থসূচক/এমএম/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.