পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইলস লিমিটেডে ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা (Sponsors) কোম্পানির অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা জমা না দিয়েই বিনা মূল্যে ১৬১ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার নিয়েছেন। যদিও প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের প্রসপেক্টাসে টাকার বিপরীতে এই শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
কোম্পানিটির উদ্যোক্তারা নিজেরা শুধু নয়, জালিয়াতির মাধ্যমে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও বিনামূল্যে শেয়ার দিয়েছে। প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশী ৭৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ১১৪ কোটি টাকার শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৩৩ জন ব্যক্তি কোনো টাকা জমা না দিয়েই শেয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন। তবে এদের নামে কত টাকার শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, নানা জালিয়াতি আড়াল এবং সহজে আইপিওর অনুমোদন পেতে এই ব্যক্তিদের নামে বিনামূল্যে শেয়ার ইস্যু করা হয়। আর এই ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্টের প্রকৃত সুবিধাভুগী সমাজের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি। যথারীতি এদের ক্ষেত্রেও প্রসপেক্টাসে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো টাকা জমা না দিলেও টাকার বিনিময়ে শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে বলে প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করা হয়েছে।
লক-ইনের (শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা) মেয়াদ শেষে বাজারে ওই শেয়ার বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এই জালিয়াতি করা হয়েছে।
রিং শাইনের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের গঠন করা এক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এই জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মেজবাহ উদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে রিং শাইনের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। নতুন পর্ষদ কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা জানতে বিশেষ অডিট ও তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। ওই তদন্তেই রিং শাইনের শেয়ার জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে।
গতকাল বুধবার (২৩ জুন) বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৭৭৯তম কমিশন সভায় রিং শাইন টেক্সটাইলসের তদন্ত প্রতিবেদনের উপাত্ত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য উপস্থাপন করা হয়। কমিশন বৈঠকে, সাধারণ বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারে সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে কমিশন তদন্ত প্রতিবেদনের কিছু বিষয় সবার জন্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়।
কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে, বৃহস্পতিবার বিএসইসি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, রিং শাইন টেক্সটাইল প্রাইভেট অফারের মাধ্যমে বিদ্যমান উদ্যোক্তা-পরিচালক এবং ৭৩ জন বাইরের স্থানীয় শেয়ারহোল্ডারদের অনুকূলে ২৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকার সাধারণ শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৮৫ কোটি ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করেছে। এর মধ্যে কোম্পানিটির ১১ জন উদ্যোক্তা-পরিচালক ও ৩৩ জন বাইরের স্থানীয় শেয়ারহোল্ডার তাদের অনুকূলে ইস্যু করা শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিকে কোনো অর্থ পরিশোধ করেনি।
এর আগে গত মাসে বিএসইসির ৭৭৪তম কমিশন সভায় রিং শাইনের প্রাইভেট প্লেসমেন্টে টাকা ছাড়া বরাদ্দ দেওয়া সব সব শেয়ার এবং তার বিপরীতে ইস্যু করা বোনাস শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবার এর পাশাপাশি জালিয়াতি করে উদ্যোক্তাদের নামে টাকা ছাড়াই ইস্যু করা সব শেয়ার বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে কমিশন এই জালিয়াতির ঘটনায় রিং শাইনের ১১ উদ্যোক্তা পরিচালক এবং টাকা জমা না দিয়ে শেয়ার গ্রহণকারী ৩৩ ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও সিকিউরিটিজ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২০১৯ আইপিওতে আসা কোম্পানিটির নীরিক্ষক ছিল মাহফেল হক অ্যান্ড কোং। আইপিওতে আসার আগের বছরে নিরীক্ষক ছিল আহমেদ অ্যান্ড আখতার কোং। আর এর আগের বছর নিরীক্ষা করেছে ধর অ্যান্ড কোং।
এদিকে রিং শাইনের জালিয়াতিতে নীরিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়েও সন্দেহ করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি খোদ বিএসইসিরও এই সন্দেহ। ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা না করা সত্ত্বেও শেয়ার ইস্যু করার বিষয়টি নীরিক্ষায় ধরা না পড়ার কোনো কারণই নেই বলে মনে করছেন তারা। তাই রিং শাইন ইস্যুতে মাহফেল হক অ্যান্ড কোং দায় খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। তবে ইস্যু ম্যানেজারের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
উল্লেখ, ২০১৯ সালে আইপিওতে আসার পর থেকেই রিং শাইনের জালিয়াতি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। আইপিওর কিছুদিনের মধ্যে আইপিওতে ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহকারী কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে গুজব রটে যায়। এর প্রেক্ষিতে বিএসইসির অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানিটির সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে। এক পর্যায়ে কোম্পানিটির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসির বর্তমান কমিশন গত ২০ মে রিং শাইনের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু টাকাও ছাড় করা হয়। বর্তমানে কোম্পানিটি সীমিত পরিসরে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.