বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী পুরো এলাকা এখন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। ফলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় তারা নানা ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে, যা নিয়ে এখন বাড়তি সতর্কতায় রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
অভিযোগ রয়েছে, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, জেলে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় এবং রোহিঙ্গা পাচারের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে আরাকান আর্মি। স্থানীয় পর্যায়ে জানা গেছে, নাফ নদী ও স্থল সীমান্তের পুরোটাই রয়েছে তাদের দখলে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পরবর্তী অভিযান চালাতে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহে মরিয়া এই সশস্ত্র সংগঠন।
সীমান্তে বাংলাদেশ কঠোর নজরদারি বাড়ানোয় আরাকান আর্মি কিছুটা চাপে পড়েছে। তাদের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, চালের সংকট না থাকলেও খাদ্য, ওষুধ ও পোশাকের সংকটে রয়েছে তারা। তাই তারা সীমান্তবর্তী এলাকায় নানা তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে চাপের মুখে ফেলতে চাইছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরাকান আর্মির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সীমান্তে বিজিবির টহল ও সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সীমান্তে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে
সম্প্রতি নাফ নদী থেকে একাধিকবার বাংলাদেশি জেলেকে অপহরণ করেছে আরাকান আর্মি। ২৬ আগস্ট টেকনাফের নাইখংদিয়া এলাকা থেকে ১১ জন জেলেকে দুটি ট্রলারসহ ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০ থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ৫১ জন জেলে অপহৃত হয়, যাদের এখনো ছাড়া সম্ভব হয়নি।
ট্রলার মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, ৫ থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ২৩ দিনে ১০টি ট্রলারসহ ৬৩ জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২৬৭ জন জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলেও ১৮৯ জনকে এবং ২৭টি নৌযান ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে কোস্ট গার্ড বাংলাদেশের জলসীমায় টহল জোরদার করেছে। জেলেদের মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রমে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ২৯ আগস্ট সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমারে ঢুকে পড়া ১৯টি ট্রলার ও ১২২ জেলেকে ফেরত আনা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৯ জন বাংলাদেশি ও ৯৩ জন রোহিঙ্গা।
অস্ত্র পাচার ও মানবপাচারের রুটে পরিণত সীমান্ত
২৭ আগস্ট টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের খরের দ্বীপে বিজিবির টহল দলের ওপর গুলি চালানো হয়। পরে অভিযান চালিয়ে দুটি জি-৩ রাইফেল, একটি এমএ-১, একটি এলএম-১৬ এবং ৫০৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। বিজিবি জানায়, নদীপথে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে অভিযানে গেলে তারা পালিয়ে যায়।
১১ আগস্ট উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী সীমান্তে এক তরুণ একে-৪৭ রাইফেলসহ আত্মসমর্পণ করে, বিজিবি দাবি করে সে আরাকান আর্মির সদস্য। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে যারা আরাকান আর্মির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তারা এখন আত্মসমর্পণ করতে চাইছে।
৬৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, “খরের দ্বীপ থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র সীমান্তবর্তী চোরাকারবারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। এসব অস্ত্র মজুদ করা হয়েছিল সন্ত্রাসী কার্যক্রম, মাদক বা অস্ত্র চোরাচালানের জন্য।” তিনি বলেন, “সীমান্তে কোনো ধরনের অস্ত্র চোরাচালান হতে দেওয়া হবে না, আমরা সতর্ক আছি।”
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও নতুন চ্যালেঞ্জ
মিয়ানমার সীমান্তে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের দিকে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। যদিও তারা দলবেঁধে ঢুকতে পারছে না, তবে বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অনুপ্রবেশের পেছনে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট কাজ করছে, যার সঙ্গে স্থানীয় রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির সদস্যরা যুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের জানান, “রাখাইনে রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মির নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।” ফটো সাংবাদিক সেলিম খান বলেন, “যারা টাকা দিচ্ছে তারাই সীমান্ত পার হতে পারছে। আরাকান আর্মি একদিকে নির্যাতন করছে, অন্যদিকে টাকা নিয়ে কক্সবাজারে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে।”
সীমান্তে গোলাগুলি ও উত্তেজনা
২৩ আগস্ট টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। রাখাইন সীমান্তে প্রায়ই গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে নিয়মিত গোলাগুলি হচ্ছে।
মিয়ানমারের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, “আরাকান আর্মি এখন শুধু সামরিক জান্তা নয়, বরং আরসা, আরএসওসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এর ফলে তারা অস্ত্র ও অর্থ সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সংগ্রহ এবং মাদক চোরাচালান বাড়িয়ে অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা করছে।”
বিজিবির প্রস্তুতি ও কড়াকড়ি
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, “সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির শব্দ প্রায়ই শোনা যায়। কখনো কখনো তা আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসে। তারা আমাদের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে।”
তিনি বলেন, “মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনা বেড়েছে। আগে জান্তা ইয়াবা পাচার করতো, এখন তা নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি।”
কক্সবাজার বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ জানান, “বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না। সীমান্তে অপতৎপরতা কঠোরভাবে দমন করা হবে।” তিনি বলেন, “মানবিক কারণে কিছু আহত ও অসহায় রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে, তবে সীমান্ত সুরক্ষায় সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করছি। সীমান্তে বিজিবির জনবল বাড়ানো হয়েছে।”
গত এক বছরে কেবল বিজিবি এক হাজার ৩২১ কোটি টাকার মাদক জব্দ করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে, যার মধ্যে ৮৪ কিলোমিটার জলসীমানা। এসব দুর্গম এলাকা দিয়ে ইয়াবা, আইস ও অস্ত্র আসছে।
মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, “মিয়ানমারে নির্বাচন সামনে। রাখাইনে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। আরাকান আর্মি এখন মরিয়া। বাংলাদেশ সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।”
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.