‘ভোট চুরি’র প্রশ্নে মুখোমুখি রাহুল গান্ধী ও নির্বাচন কমিশন

ভোটার তালিকায় কারচুপি করে ব্যাপকভাবে ‘ভোট চুরি’ করা হচ্ছে, এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশন ও লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী কার্যত মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছেন।

কমিশন গান্ধীকে হয় হলফনামা পেশ করার অথবা জাতির কাছে ক্ষমা চাইবার আহ্বান জানিয়েছে, অন্য দিকে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা বিহারের মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ আবারও কমিশনের বিরুদ্ধে ‘ভোট চুরি’র অভিযোগ তুলেছেন।

রবিবার বিকেলে দিল্লিতে যৌথ সাংবাদিক বৈঠক করে দেশের তিনজন নির্বাচন কমিশনার একযোগে অভিযোগ জানান, রাহুল গান্ধী যা করেছেন, তা ‘সংবিধানের অবমাননা’ ছাড়া কিছুই নয়।

দুই কমিশনার সুখবীর সিং সান্ধু ও বিবেক জোশীকে পাশে নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার এদিন বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের ভোটারদের নিশানা করতে নির্বাচন কমিশনকে একটি লঞ্চপ্যাড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

‘কমিশনের চোখে শাসক বা বিরোধী – সব রাজনৈতিক দলই সমান’ বলে দাবি করে এবং রাহুল গান্ধীকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, যারা ‘ভোট জালিয়াতি’ বা ‘ভোট চুরি’র মতো শব্দ ব্যবহার করছেন, তারা আসলে দেশের সংবিধানেরই অমর্যাদা করছেন।

ভারতের নির্বাচন কমিশন যখন রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করছেন, তার মাত্র কিছুক্ষণ আগেই রাহুল আজ বিহারে তার ষোলো দিন-ব্যাপী ও ১৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’র সূচনা করেন।

বিহারের সাসারামে সেই যাত্রার সূচনাতেও তিনি অভিযোগ তোলেন, সারা দেশেই বিধানসভার নির্বাচনগুলো এবং লোকসভার নির্বাচন লুঠ করা হচ্ছে ভোটার তালিকায় কারচুপি করে। বিহারে ভোটার তালিকায় যে ‘এসআইআর’ বা ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশনে’র (বিশেষ নিবিড় পর্যালোচনা) কাজ চলছে, তাতেও ভোটারদের নাম সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে।

ভোটার তালিকায় এই গরমিলের অভিযোগকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনীতি গত বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তাল হয়ে আছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিহারের ‘এসআইআর’ প্রক্রিয়া, যাতে প্রাথমিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৬৫ লাখ ভোটারের নাম বাদ পড়েছে। দেশের প্রায় সব বিরোধী দল এই ‘এসআইআর’-এর তীব্র বিরোধিতা করছে।

বলা যেতে পারে, আজ দেশের একটি অন্যতম প্রধান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান – জাতীয় নির্বাচন কমিশনও সেই বিতর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িয়ে পড়লো।

এই গোটা বিতর্কের সূচনা হয়েছিল গত ৭ অগাস্ট, যখন রাহুল গান্ধী দিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দফতরে একটি ভিন্নধর্মী সাংবাদিক সম্মেলন বক্তব্য দেন। তার কয়েকদিন আগেই তিনি বলেছিলেন, তিনি খুব শিগগিরি একটা ‘অ্যাটম বম্ব’ ফাটাবেন!

সে দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি নির্বাচন কমিশনেরই দেওয়া ডেটা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখান, ২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনে শুধু ব্যাঙ্গালোরের মহাদেবপুরা আসনেই অন্তত এক লক্ষ ভোটারের হিসেবে কারচুপি করা হয়েছিল।

কীভাবে মাত্র ১০ বর্গফুটের একটি বাড়িতে ৮০ জন ভোটারকে নথিভুক্ত করা হয়েছিল, এবং তালিকায় আরও হাজার হাজার ভুয়া এন্ট্রি করা হয়েছিল বা বৈধ ভোটারের নাম বাদ পড়েছিল – মহাদেবপুরা থেকে সেই উদাহরণও তুলে ধরেন তিনি। যদিও এই সব দাবির কোনো কোনোটি নিয়ে পরে পাল্টা প্রশ্নও উঠেছে।

ওই একটি কেন্দ্রের হিসেব ‘এক্সট্রাপোলেট’ করে তিনি আরও দাবি করেন, সারা দেশে যদি ৩০টি আসনেও এই মাপের ভোটার তালিকায় গরমিল থেকে থাকে– এবং তার সুবিধা নিয়ে সেগুলোতে ক্ষমতাসীন দল জিতে থাকে, তাহলে খাঁটি ভোটার তালিকায় ভোট হলে নরেন্দ্র মোদীর টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া হতো না। ভোটার তালিকায় এভাবে কারসাজি করার বিষয়টিতে বিজেপি ও নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশ ছিল বলেও তিনি অভিযোগ তোলেন।

ভারতের কোনো শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ এভাবে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিয়ে এর আগে এরকম ‘ডেটা রিচ’ কোনো সাংবাদিক সম্মেলন কখনোই করেননি, তাই সে দিন রাহুল গান্ধীর বক্তব্য পেশকে সব দিক থেকেই ব্যতিক্রমী বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।

তবে নির্বাচন কমিশন রাহুল গান্ধীর সব অভিযোগই উড়িয়ে দিয়ে পাল্টা দাবি করেছে, হয় তাকে নিজের অভিযোগের স্বপক্ষে শপথ নিয়ে কোনো হলফনামা পেশ করতে হবে -অথবা মিথ্যা অভিযোগ তোলার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের নেতৃত্বে তিনজন কমিশনারের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনেও এদিন সেই বক্তব্যই তুলে ধরা হয়েছে। জ্ঞানেশ কুমার বলেন, রাহুল গান্ধী যদি সব নিয়ম মেনে সাতদিনের মধ্যে কোনো হলফনামা জমা না দেন – কিংবা জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমাও না চান – তাহলে কমিশন ধরেই নেবে তার তোলা সব অভিযোগই ভিত্তিহীন।

রাহুল গান্ধী যেহেতু মহাদেবপুরা আসনের ভোটার নন, তাই ওই আসনের ভোটার তালিকা নিয়ে কোনো অভিযোগ জানাতে হলে তার নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন আছে।

কমিশন আরও জানায়, এরকম ক্ষেত্রে হলফনামা জমা দেওয়ার নিয়ম হলো সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের নির্বাচনী রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তার কাছে শপথ নিয়ে একজন ‘সাক্ষী’ (উইটনেস) হিসেবে তাকে অভিযোগ নথিভুক্ত করতে হবে।

শুধু তাই নয়, যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে শপথ নেওয়ার সময় তার সামনেই সেটা নিতে হবে।

রাহুল গান্ধী অবশ্য ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, তিনি একজন এমপি হিসেবে দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ভারতের সংবিধান ছুঁয়ে শপথ নিয়ে ফেলেছেন– ফলে নতুন করে তিনি আর কোনো শপথ নেবেন না।

তবে জাতীয় নির্বাচন কমিশন এদিন স্পষ্ট করে দিয়েছে, রাহুল গান্ধীর কাছ থেকে হলফনামা না পেলে তারা অভিযোগগুলোর তদন্ত নিয়ে এক পা-ও এগোতে রাজি নয়!

দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সাংবাদিক সম্মেলনের পর পরই প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কংগ্রেস নেতা ও মুখপাত্র পবন খেড়া বলেন, এ তো বোঝাই যাচ্ছে যে কমিশন বিজেপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।

এদিকে আজ থেকেই নির্বাচন-মুখী বিহারে ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’র সূচনা করেছেন তার দলনেতা রাহুল গান্ধী। পরবর্তী ষোলো দিন ধরে রাজ্যের ২০টি জেলার মধ্যে দিয়ে এই যাত্রা ১৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দেবে, যাতে নেতৃত্ব দেবেন রাহুল গান্ধী নিজে।

যাত্রার শুরুতে সাসারামে দাঁড়িয়ে রাহুল গান্ধী এদিন বলেন, আমরা কিছুতেই বিহারে ওদের ভোট চুরি করতে দেব না। বিহারের মানুষ কিছুতেই চাইবেন না তাদের ভোটের অধিকার কেউ চুরি করে নিক। গরিব মানুষের একটাই অধিকার আছে, সেটা ভোটের অধিকার। কোনো মূল্যেই আমরা সেটা চুরি হতে দেব না।

বিহারে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা আগামী নভেম্বরে – ফলে আর মাসতিনেকের মধ্যেই। ভোটার তালিকা নিয়ে এক দিকে বিজেপি ও নির্বাচন কমিশন, আর অন্যদিকে বিরোধীদের তীব্র সংঘাতের প্রথম ক্ষেত্রটি হতে যাচ্ছে এ রাজ্যেই। খবর- বিবিসি বাংলা

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.