আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলার ঋণ আবেদন করেছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর শেষ পর্যন্ত মাত্র পৌনে ১ বিলিয়ন (৭৫ কোটি) ডলারের চুক্তি হয়েছে। একই সঙ্গে আগে পাশ হওয়া ঋণের চতুর্থ কিস্তির অঙ্ক প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য আইএমফের বোর্ড সভায় অনুমোদনের পর চতুর্থ কিস্তির ৬৪ দশমিক ৫০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। যদিও এই কিস্তিতে অন্তত ১১০ কোটি ডলার ছাড় করার আবেদন করেছিল সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন আর্থিক তথ্য গোপন করে সূচকের উন্নতি এবং কঠিন শর্ত মেনে আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই নীতি থেকে সড়ে এসেছে। আর্থিক সূচক খারাপ হবে এটা জেনেও খেলাপি ঋণ, মূল্যস্ফীতি এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সূচকগুলোতে ব্যাপক অবনতি হয়। আর আর্থিক সূচকের অবনতির কারণে ঋণে কঠোর শর্ত জুড়ে দেয় আইএমএফ। কঠিন শর্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালনীর দাম বৃদ্ধির মতো কঠিন শর্ত মানতে রাজি না হওয়ায় ৩ বিলিয়নের ঋণ চুক্তি এক বিলিয়নের নিচে নেমে আসে।
আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এরপর তিন কিস্তিতে সংস্থাটি থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল নাগাদ পুরো অর্থ পাওয়ার কথা রয়েছে। এর বাইরে সংস্থাটি থেকে সম্প্রতি আরও ৩০০ কোটি ডলার ঋণের আবেদন করে বাংলাদেশ। চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা ও নতুন ঋণের বিষয়ে দরকষাকষি করতে গত ৩ ডিসেম্বর থেকে আইএমএফ গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেছে। মিশনটি চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে অনেকটা ঐকমত্যে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে নতুন করে ৭৫ কোটি ডলার ঋণের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব আদায় ও নীতি গ্রহণ সংস্থাকে আলাদা করতে হবে। কারণ একই প্রতিষ্ঠান দুই কাজ করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে ছাড় দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ থাকে। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারও এটি করতে চায়। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে আরও শক্তিশালী করে আলাদা সচিব নিয়োগ দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। যার নেতৃত্বেই হবে রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের দায়িত্বে থাকবে। বর্তমানে একজনই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তবে কর্মকর্তারা মনে করেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়াটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার এনবিআরও এটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করতে চায় না। তাই এটি কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তা ছাড়া নতুন ঋণের শর্তে করছাড় আরও কমিয়ে আনার পাশাপাশি ভ্যাটহার এক স্তরে নামিয়ে আনার বিষয়টিও থাকছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ভর্তুকির চাপ কমিয়ে আনতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মতো জনসম্পৃক্ত কঠিন শর্তও সংযুক্ত করতে চেয়েছে সংস্থাটি। তবে সরকার অন্তত আগামী জুন পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় না। এর বাইরে আরও কিছু শর্ত আরোপ করা হয়। এর পাশাপাশি চলমান ঋণ কর্মসূচির শর্তগুলোও অব্যাহত থাকবে।
জানা গেছে, প্রায় আড়াই মাস আগে যখন বাড়তি তিন বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়, তখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা বেশ নাজুক ছিল। বর্তমানে এ অবস্থা বেশ উন্নতি হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহও ভালো। এ অবস্থায় কঠিন শর্তে রাজি হয়নি সরকার। এসব শর্ত ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাড়তি ঋণের বিষয়ে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা দেখা করেন। প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শের ভিত্তিতে আইএমএফ মিশনের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে প্রতিটি কিস্তি পেতে বেশকিছু শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে। চতুর্থ কিস্তির জন্য গত জুনভিত্তিক দেওয়া বিভিন্ন শর্তের মধ্যে কর-রাজস্ব সংগ্রহ ছাড়া সব শর্ত পূরণ হয়েছে। তাই এবার মিশনের অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকে বারবারই উঠে এসেছে কর আহরণ বাড়ানোর বিষয়টি। চলতি অর্থবছরেই অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বলেছে মিশন। এ লক্ষ্য অর্জনে বেশকিছু পণ্যে হ্রাসকৃত হারের ভ্যাট সুবিধা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করছে সরকার। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়তে পারে।
এদিকে চলমান কর্মসূচির প্রথম কিস্তি ছাড় করার পর পরবর্তী অর্থ সমান ছয় কিস্তিতে ছাড় করার কথা ছিল। সে হিসেবে প্রতি কিস্তির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭০ কোটি ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির পরিমাণ বাড়ানোর অনুরোধ করলে সংস্কার কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে তৃতীয় কিস্তিতে ১১৫ কোটি ডলার ছাড় করে আইএমএফ। তাই চতুর্থ কিস্তিতেও বাড়তি ডলার পাওয়ার আশা করেছিল সরকার। সে হিসেবে সফররত মিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আগামী জানুয়ারি মাস নাগাদ চতুর্থ কিস্তিতে প্রায় ১১০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কিস্তির পরিমান অনেকটাই কমে গেছে। ফলে চতুর্থ কিস্তিতে পাওয়া যাবে মাত্র ৬৪ কোটি ডলার। বাড়তি ডলার দেওয়ার বিষয়ে মিশনের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি সরকার। গতকাল বিকেলে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে মিশনের সমাপনী বৈঠক করে আইএমএফের প্রতিনিধি দল।
এদিকে বৈঠক শেষে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, বন্যা ও সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণের কারণে বছর শেষে প্রবৃদ্ধি হতে পারে মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
তবে সময়মতো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করায় ক্রমান্বয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এখনো ধীরগতি ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ব্যাংক থেকে মূলধন বের হয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে চাপে ফেলেছে বলেও মত দিয়েছে আইএমএফ। এছাড়া রাজস্ব আয় কমছে, যদিও বাড়ছে সরকারের ব্যয়ের চাপ। এসব চ্যালেঞ্জ আর্থিকখাতকে দুর্দশার মধ্যে ফেলছে । সংস্থাটি আরও জানায়, ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় ও বর্ধিত ঋণ দেয়ার বিষয়ে বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.