অগ্নি পরীক্ষার মুখে বেক্সিমকো লিমিটেডের বিনিয়োগকারীরা

পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক নাজুক অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের শেষ নেই। টানা দর পতনে কেবলই লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে তাদের। এদের মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেডের বিনিয়োগকারীরা নতুন অগ্নি পরীক্ষার মুখোমুখী। দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লভ্যাংশ ঘোষণা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আজ বৈঠকে বসছে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ। ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা কোম্পানিটির মুনাফা ও ঘোষিত লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ-আতঙ্কের ব্যারোমিটার হিসেবে দেখা দিবে।

বেক্সিমকো লিমিটেড দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্প গোষ্ঠি বেক্সিমকো’র ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি। এটি পুঁজিবাজারের সবচেয়ে আলোচিত-বিতর্কিত কোম্পানিগুলোরও অন্যতম। গত পাঁচ বছরে অনেক নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের পারিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন এ কোম্পানি। এ সময়ে কোম্পানির মুনাফা, লভ্যাংশ ও শেয়ারের দামে বড় উত্থান-পতন দেখা গেছে।

২০১৯ সাল পর্যন্ত বেক্সিমকোর মুনাফা ও ঘোষিত লভ্যাংশের হার ছিল একেবারেই নগন্য। কোম্পানির শেয়ারের দামও ছিল তলানীতে। পরবর্তী দুই বছর সব কিছুতেই বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। এ সময়ে কোম্পানিটি সুকুক নামের ইসলামী বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। তারপর থেকে কোম্পানির পারফরম্যান্সে উল্টোমুখী ধারা চলতে থাকে।

দীর্ঘদিন মন্দায় থাকার পর ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে চাঙ্গা হতে থাকে দেশের পুঁজিবাজার। এ সময়ে লেনদেন পরিমাণ ও সূচক বৃদ্ধিতে বেক্সিমকো লিমিটেডকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। ওই বছরের ২০ জুলাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ১৩ টাকা। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে এটি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে (২৫.৬০ টাকা) উন্নীত হয়। আগস্ট মাস থেকে বেক্সিমকোর শেয়ারের দর বৃদ্ধির গতি আরও বেড়ে যায়। শেয়ারের দর বৃদ্ধির ধারার মধ্যেই ২০২১ সালের মার্চ মাসে জানা যায় কোম্পানিটি সুকুক ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। তার কিছুদিন আগেই কোম্পানিটি বেক্সিমকো হোল্ডিংস থেকে ৩৫ কোটি টাকায় বেক্সপাওয়ার নামে একটি কোম্পানির সাড়ে তিন কোটি শেয়ার কেনে। তিস্তা সোলার লিমিটেড ও করতোয়া সোলার লিমিটেডের ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে বেক্সপাওয়ারের কাছে। সুকুকের মাধ্যমে সংগ্রহ করা অর্থের বড় অংশ এই তিস্তা সোলার ও করতোয়া সোলারে বিনিয়োগ করা হবে বলে জানানো হয়।

সুকুক ইস্যুর খবরে বেক্সিমকোর শেয়ার আরও তেজী হয়ে উঠে। ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে ১৮৭ টাকায় উঠে। তবে সুকুক ইস্যুর পর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ারের গতি উল্টোদিকে মোড় নেয়। শেয়ারের দর হারাতে থাকে কোম্পানিটি। বর্তমানে এটি ফ্লোরপ্রাইস ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায় আটকে আছে। লেনদেন হয় না বললেই চলে। আজ সোমবার (২৮ অক্টোবর) ডিএসইতে বেক্সিমকোর মাত্র ১টি শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৯ সালে বেক্সিমকোর ইপিএস ছিল মাত্র ১ টাকা ৬৩ পয়সা। পরের বছর তা কমে ৫১ পয়সায় নেমে আসে। এই দুই বছরে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য মাত্র ৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। কিন্তু ২০২১ সালে কোম্পানিটির মুনাফা ও লভ্যাংশে নাটকীয় উত্থান ঘটে। এ বছর ইপিএস এক হাজার ৩৭৬ শতাংশ বেড়ে ৭ টাকা ৫৩ পয়সা হয়। এ বছরের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয় ৩৫ শতাংশ। এ বছরই কোম্পানিটি সুকুক ইস্যুর ঘোষণা দেয়। পরের বছর কোম্পানির ইপিএস আরও বেড়ে ১৪ টাকা ৩২ পয়সা হয়। তবে কমে যায় লভ্যাংশের হার। ইপিএস বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও লভ্যাংশের হার কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়। ততদিনে কোম্পানিটির সুকুক ইস্যু করে বাজার থেকে টাকা তোলা শেষ। ২০২৩ সালে ইপিএস কমে ৭ টাকা ৯৫ হয়। এ বছর লভ্যাংশের হার কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।

সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির ইপিএস আরও কমে ৮৯ পয়সায় নেমে আসে। এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে একাধিক হত্যা মামলার আসামী হিসেবে বেক্সিমকোর কর্ণধার সালমান এফ রহমান কারাগারে আছেন। এমনিতে কোম্পানিটির মুনাফার নিম্নমুখী ধারা, তারউপর রাজনৈতিক পরিবর্তন ও কোম্পানির কর্ণধারের জেলে থাকার কারণে লভ্যাংশের হার আগের বছরের চেয়েও কমে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন বিনিয়োগকারীরা।

ফ্লোরপ্রাইসের কারণে বাজারে বেক্সিমকোর শেয়ারের স্বাভাবিক লেনদেন না হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের বিপুল পুঁজি আটকে আছে। বড় মূলধনের এই কোম্পানিটির দর পরিবর্তন সূচকে অনেক প্রভাব ফেলে বলে ভয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এর মধ্যে কোম্পানিটির মুনাফা ও লভ্যাংশে নেতিবাচক কিছু হলে ফ্লোরপ্রাইস তুলে নেওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহারের পর শেয়ারে বড় দর পতনের আশংকা থাকবে। অন্যদিকে ফ্লোরপ্রাইস প্রত্যাহার করা না হলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে থাকবে।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.