বাজেটে কোন খাতে কত বরাদ্দ

বাজেট ২০২৪-২৫

‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ শিরোনামে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বৃহস্পতিবার (৬ জুন) বিকেলে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ শুরু হয়।

প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩৮ হাজার ২৫৯ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মন্ত্রণালয়ে বাজেট বেড়েছে মাত্র ২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।

কোন খাতে কত বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে…

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে সর্বমোট ২ হাজার ২১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে ১ হাজার ২৩৪ কোটি ৮ লাখ টাকা এবং পরিচালন খাতে ৯৭৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন খাতের পরিমাণ ছিল ৬০১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং পরিচালন খাতের পরিমাণ ছিল ৯২১ কোটি ৬৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে গত অর্থ বছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মোট সংশোধিত বাজেট এর পরিমান ছিল ১ হাজার ৫২৩ কোটি ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ এবারের প্রস্তাবিত বাজেট গত বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬৮৮ কোটি ৬০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বেশি।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় খাতে ৪৬ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছরে এই খাতে বাজেটের পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা।

শিল্প মন্ত্রণালয়
২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জন্য ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ কমেছে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা।

শিক্ষা খাত
২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৪২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। এবার বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা।

অপরদিকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে— যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এবার ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাত
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার (৬ জুন) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য ৩০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ২৯ হাজার ২৩০ কোটি এবং জ্বালানি খাতে ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৪ হাজার ৫০২ কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।

প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিরক্ষা সার্ভিসে ৪০ হাজার ৮২ কোটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য সার্ভিসে ১ হাজার ৮৮৬ কোটি ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের জন্য ৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জন্য ৬ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছরে এই খাতে বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে দাঁড়িয়েছিল ৭ হাজার ২৫ কোটি টাকা।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন খাত
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৬৫৫ কোটি টাকা কম, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৪ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বাবদ সংশোধিত বাজেট ছিল ৩ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। আর মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়
প্রস্তাবিত বাজেটে নৌ-পরিবহন খাতে ১১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই খাতে প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ১০ হাজার ৮০১ কোটি টাকা অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রস্তাবিত বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪৬৯ কোটি টাকা।

নারী-শিশুর উন্নয়ন খাত
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫ হাজার ২২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৪৬৭ কোটি টাকা বেশি।

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এবার বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি কম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। তবে, অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছর চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বৈদেশি ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। করব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

এ ছাড়া বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল হিসেবে ব্যাংক খাত বেছে নিয়েছে সরকার। ঘাটতি পূরণে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এই অংক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাঁচ হাজার ১০৫ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় এটি বাড়িয়ে এক লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা ঠিক করা হয়েছে।

আজ বাজেট উপস্থাপনের পর নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংসদ সদস্যরা আলোচনা করবেন। এরপর আগামী ৩০ জুন প্রস্তাবিত বাজেট পাশ হবে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট এটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের শেষ বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর এটি প্রথম বাজেট। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ওই বাজেট পেশ হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ওই দিন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর, অর্থাৎ দুই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। এরপর আরও দুবার বাজেট দেন তাজউদ্দীন আহমদ, সেটি সবশেষ দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪ কোটি টাকার। ১৩ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার বাজেট দিয়েছেন সদস্য প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও এম সাইফুর রহমান। দুজনেই ১২টি বাজেট উত্থাপন করেছেন। তবে আবুল মাল আবদুল মুহিতই আওয়ামী লীগের হয়ে টানা ১০ বার বাজেট পেশ করেছেন। তিনি প্রথম বাজেট দেন ১৯৮২-৮৩ সালে, এরশাদের শাসনামলে। সেটার আকার ছিল ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.