দারুণ গাড্ডায় পড়েছেন ভারতের দারুণ প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি। তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই অন্য কোনো দলের সহায়তা-সমর্থন ছাড়া বিজেপির পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। যদিও বিজেপির নেতৃত্বাধীন কয়েকটি দলের জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) সরকার গঠনের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনে জয় পেয়েছে, সরকার গঠন নিয়ে উদ্বেগ কাটবে না নরেন্দ্র মোদির। কারণ জোটের বড় এক- দুটি দল মোচড় দিলে বা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের প্রতি সমর্থন জানালে এক ফুৎকারে উড়ে যাবে মোদির তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন। আর যদি আপাতত সরকার গঠন করা সম্ভবও হয়, তাহলে ওই সরকারের টিকে থাকার বিষয়টি নির্ভর করবে জোটশরীকদের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর।
নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির নরেন্দ্র মোদির বুকে এখন কাঁপন ধরেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্য জনসভায় মোদি ঔদ্ধত্যেরে সাথে বলতেন,’ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি আমার। কাউকে পরোয়া করি না’। সেই মোদির বুকে এখন দুরু দুরু কাঁপন। ভাবনা একটাই-এনডিএ’র শরীকদের সমর্থন শেষ পর্যন্ত বিজেপির উপর থাকবে তো। সরকার করা সম্ভব হলেও পুরো মেয়াদ কী পার করা যাবে?
ভারতের লোকসভায় মোট আসন সংখ্যা ৫৪৩টি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ২৭২টি আসনের জয় বা সমর্থন। বিকাল ৫টায় পর্যন্ত ঘোষিত ফলাফলে এনডিএ জোট ২৫ আসনে জয়ী ও ২৬৯টি আসনে এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে ইন্ডিয়া জোট ৯ আস জয়ী ও ২২২ আসনে এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে বিজেপি এককভাবে ২৪১ আসনে এগিয়ে ছিল (কয়েকটিতে জয়সহ)। এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসনের চেয়ে বিজেপির ৩১টি আসন কম। তাই সরকার গঠন নির্ভর করবে অন্য দলের সমর্থনের ওপর।
এনডিএ জোট যদি এগিয়ে থাকা সব আসনে জয় পায়, তাহলে তাদের মোট আসন হবে ২৯৪টি, যা ন্যুনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে মাত্র ২২টি বেশি। এসব আসন নিয়ে হেসেখেলে সরকার গঠন করা যাবে। কিন্তু জোটের শরীকদের মধ্যে প্রধান এক-দুটি দল যদি বেঁকে বসে বা সমর্থন না দেয়, তাহলেই বিজেপির সরকার গঠনরে আশা ভেস্তে যাবে।
অর্ধেক ভোট গণনা শেষে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে ২৪১ আসনে, আর প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ৯৯ আসনে। গত নির্বাচনে বিজেপি একাই ৩০৩টি আসন পেয়েছিল। ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে প্রয়োজন ২৭২ আসন। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় আসনের চেয়ে ৩০ আসনে পিছিয়ে রয়েছে বিজেপি।
এনডিএ জোটের শরিকদের প্রধান অন্ধ্র প্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম এগিয়ে রয়েছে ১৬ আসনে এবং বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জনতা দল-ইউনাইটেড (জেডি–ইউ) এগিয়ে রয়েছে ১৪ আসনে। জোটের অন্য শরীকদের মধ্যে মহারাষ্ট্রের শিবসেনার সিন্ধে গোষ্ঠী ৬ আসনে, বিহারে লোক জনশক্তি পার্টি ৫ আসনে এবং উত্তর প্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোক দল ৩ আসনে এগিয়ে রয়েছে।
বিজেপির পাশাপাশি কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোটও সরকার গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই জোটের পক্ষ থেকে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম এবং নীতীশের জনতা দলের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। দল দুটির সমর্থনে পেলে তাদেরকে সরকারের অংশীদার করা হবে বলে জানানো হয়েছে। ধারনা করা যায়, এ নিয়ে দলগুলো দর কষাকষি করতে পারে। যদি বিজেপির চেয়ে কংগ্রেসের কাছ থেকে মন্ত্রীত্বসহ বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা মেলে তাহলে তেলেগু দেশম ওবং জনতা দল মোদির হাত ছেড়ে রাহুলের হাত ধরলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ভারতে দল বদল, জোট বদল, জোটের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার অনেক নিয়মিত ঘটনা। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান, কর্তৃত্বের বিরোধ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে হরহামেশাই বদলের ঘটনা ঘটে। খোদ বিজেপি গত ১০ বছরে এই সংস্কৃতির আরও বিস্তার ঘটিয়েছেন। মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রসহ একাধিক রাজ্যে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য অথবা জোট সদস্যদের ভাগিয়ে নিয়ে, দল ভাঙ্গিয়ে সরকার পতন ঘটিয়েছে বিজেপি। তারপর সেখানে নতুন সরকার গড়েছে।
অন্যদিকে বিহারের নীতীশ কুমার নিজেও একজন পল্টিবাজ হিসেবে পরিচিত। কয়েকবছর আগে তিনি লালু প্রসাদ যাদবের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে বিজেপিকে সাথে নিয়ে বিহারে সরকার গঠন করেন। আবার বিজেপির সাথে নানা ইস্যুতে টানাপোড়েন দেখা দিলে তিনি ওই সরকার ছেড়ে এসে ফের লালু প্রসাদের দল আরজেডির সাথে সরকার গঠন করেন। তিনিই আজকে ইন্ডিয়া জোটের প্রধান উদ্যোক্তা। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন দলের সাথে একান্ত বৈঠক করে তিনি বিজেপিকে ঠেকাতে একটি ঐকবদ্ধ প্ল্যাটফরম গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু পরে সেখানেও টানাপোড়েন দেখা দেয়। তিনি ফের বিজেপির এনডিএ জোটে ফিরে যান। তাই তার পক্ষে এনডিএ ছেড়ে আবার ইন্ডিয়া জোটে ফিরে যাওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।
এমন অবস্থায় বিজেপির পক্ষে সরকার গঠন করা অথবা সরকার গঠনের পর ওই সরকারকে টিকিয়ে রাখার কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সারাক্ষণই আশংকায় থাকতে হবে-কেউ জোট ছেড়ে চলে যায় কি না। সব সময় সবার উপরে কর্তৃত্ব ফলিয়ে আসা মোদির পক্ষে শরীকদের নানা দাবি মেনে নেওয়া, তাদের মন যুগিয়ে চলা সহজ হবে না।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.