নীতি সুদহার বাড়িয়েও পূরণ হয়নি মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা

মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর প্রচলিত নীতিগত উপায় হলো সুদহার বাড়ানো। বাংলাদেশ ব্যাংক দেরিতে হলেও সদ্য সমাপ্ত বছরের শেষের দিকে এসে নীতি সুদহার বাড়িয়েছিলো। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির লক্ষ্য ছিলো দেশের মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা। তবে ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দেড় শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে নীতি সুদহার ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে নীতি সুদহার বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরপর গত নভেম্বরে আবারও ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। এতে বর্তমানে নীতি সুদহার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

নীতি সুদহার বাড়ালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করে তার সুদহার বৃদ্ধি পায়। একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়ে। সমাপ্ত বছরের শেষের দিকে নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হেটেছিলো। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়িয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করাই বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য।

সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে, যা গত ৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের মাসে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে। অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ সবশেষ ডিসেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ডিসেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি শহরে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং গ্রামে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতিতে উর্ধ্বগতি থাকলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, খাদ্যদ্রব্য, বাড়িভাড়া ও পোশাক’সহ অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যায়। এসব পণ্য কিনতে মানুষকে আগের চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। মূল্যস্ফীতি বাড়লেও অনেক সময় মানুষের আয়ের কোনো পরিবর্তন হয় না। এক্ষেত্রে মানুষ চাহিদার তুলনায় কম কিনতে বাধ্য হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের উপর। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে অনেক পণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলে যায়। এর ফলে মানুষের সঞ্চয় কমে যায়। পাশাপাশি আগের সঞ্চয় করা অর্থ খরচ করে চলতে হয় এসব নিম্ন আয়ের মানুষদের।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে ৯ শতাংশের উপরে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে জাতীয় মজুরির হার এখন কম। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে মানুষের নিট বিনিয়োগও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সংসারের খরচ সামলান অনেকেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নভেম্বর মাসে নিট বিনিয়োগ (বিক্রি) ঋণাত্মক হয়েছে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। আগের মাসেও নিট বিক্রি ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণাত্মক ছিল। আর সেপ্টেম্বর মাসে ঋণাত্মক ছিল ১৪৭ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ভাঙানোর প্রবণতা কম থাকায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ বেশ বেড়েছিল। ওই দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) নিট বিক্রি ৫ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ইতিবাচক ছিল।

সবমিলে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়েও নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল, তবে ওই সময় এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ নিট বিক্রি ঋণাত্মক বেড়েছে ১৪০ শতাংশ। নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। সঞ্চয় ভাঙ্গার প্রবণতা দেখলেই মানুষের উপর মূল্যস্ফীতি বোঝা যায়।

মতিঝিলের বাসিন্দা রায়হান কবির বেসরকারি খাতের একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি ২০২২ সালেও সংসারের সব খরচ চালিয়ে সামান্য কিছু সঞ্চয় করতে পারতেন। সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আর সেই আগের হিসাব মিলছে না। মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতনের সব টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদিও তার বেতন আগের মতোই আছে।

তিনি অর্থসূচককে বলেন, ‘২০২২ সালে প্রতি কেজি চাল কিনতাম ৬৫ টাকা। একই চালের জন্য এখন খরচ করতে হচ্ছে ৭৫ টাকা। একই সময়ে বাড়ি ভাড়া ও যাতায়ত খরচও বেড়েছে।’

দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে নীতি সুদহার বাড়িয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি টাকার সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এরপরেও ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

অর্থসূচক/মো.সুলাইমান/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.