বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ বাংলাদেশ

যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি আর ছোট-বড় অজস্র নির্মাণ কাজের ফলে রাস্তাঘাটে ধুলো-বালির স্তূপ, ইটের ভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, আবর্জনা পোড়ানো, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, কিংবা গ্রামে-গঞ্জে রান্নার কাজে ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া ইত্যাদি নানা কারণেই দেশের বাতাস অনেক দিন ধরেই দূষিত।

মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট বৈশ্বিক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স- ২০২৩ এই শিরোণামে। প্রতিবেদনের জন্য মূলত স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ২০২১ সালের বাতাসের গুণমান বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে দেখা যা্চ্ছে, প্রতি ঘনমিটারে বাতাসে সর্বোচ্চ যে দূষণ কণা মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, অর্থাৎ ৫ মাইক্রোগ্রাম, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী এসব গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি তার চাইতে ১৪ থেকে ১৬ গুণ বেশি। বায়ু দূষণের বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ। এই দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে প্রায় ৬.৮ বছর। এলাকাভেদে এই পরিস্থিতি আরো করুণ।

গবেষণা দেখা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুরে দেশের সবচেয়ে ‘দূষিত’ জেলা এবং বায়ু দূষণের কারণে এই জেলায় বসবাসরত মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ৮.৩ বছর। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ১৫ মাইক্রোগ্রামকে মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী এসব গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৭০ থেকে ৮০ মাইক্রোগ্রাম, যা দেশ হিসেবে বিশ্বে সর্বোচ্চ, যদিও ভারতের উত্তর সমতল, বিশেষত রাজধানী দিল্লীর আশেপাশে এরকম কণার উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ১২৬ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মানের চেয়ে প্রায় ২৫ গুণ বেশি।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও কিছু ভারতীয় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয়, সামগ্রিকভাবে সবচেয়ে দূষিত দেশ বাংলাদেশ ।

এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে কম দূষিত যে জেলা সেই সিলেটেও কণা দূষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে ৯.৭ গুণ এবং জাতীয় মানের ৩.২ গুণ বেশি বলে জানিয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনটি। গড় আয়ু বিবেচনা, বায়ু দূষণ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যহৃদ রোগের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে প্রতিবেদনটি উল্লেখ করেছে। এর প্রভাব ধুমপানের চেয়ে মারাত্মক। তামাক সেবনের কারণে গড় আয়ু যেখানে কমে যাচ্ছে ২.১ বছর, যখন শিশু এবং মাতৃ অপুষ্টি গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে ১.৮ বছর, বায়ু দূষণের প্রভাব দেখা যাচ্ছে এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি।

বায়ু দূষণের ফলে মানুষের গড় আয়ুতে সবচাইতে বেশি প্রভাব পড়ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এই দুটি অঞ্চলে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের বসবাস। দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশেরও বেশি এই অংশটি গড় আয়ু হারাচ্ছে ৭.৬ বছর। বাংলাদেশ যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী বায়ু দূষণ কমিয়ে আনতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবহুল জেলা ঢাকার বাসিন্দাদের আয়ু বেড়ে যাবে ৮.১ বছর। দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দারা বাড়তি ৬.৯ বছর আয়ু লাভ করবে বলে জানিয়েছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।

বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সবচাইতে দূষিত দেশ বললেও গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ ২.২ শতাংশ কমেছে যদিও এর কোনো কারণ তারা উল্লেখ করেননি। তবে দেশের বিশেজ্ঞরা বলেছেন, কোভিডকালীন লক ডাউনের কারণেই মূলত সেসময় সাময়িক কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে ২০২২ সালে কোভিড পরবর্তী সময়ে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আবার বায়ু দূষণ বেড়েছে বলেই তারা জানিয়েছেন।

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেয়ারিক পলিউশন স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার মনে করেন, বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবের ফলেই এক্ষেত্রে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তিনি ইটের ভাটা এবং শিল্প কারখানায় যে বায়ু দূষণ হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাজ করার কথা বলেছেন। আবার নির্মাণ কাজের যে বায়ু দূষণ হয়, গৃহায়ন বা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বা রাজউককে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলছেন। আবার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ফলে যে দূষণ হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কিংবা সিটি কর্পোরেশনকে কাজ করার কথা বলেছেন। “এখানে মাল্টি মিনিস্ট্রিয়াল কিছু বিষয় আছে। ফলে বায়ু দূষণের কাজটিও মাল্টি মিনিস্ট্রিয়াল বা সমন্বিতভাবে করতে হবে। সকলের সম্মিলিত বা অংশীদারিত্বমূলক চেষ্টা থাকলেই বায়ু দূষণ কমবে।

অধ্যাপক কামরুজ্জামানের পর্যবেক্ষণ অনুসারে ঢাকা শহরে যে ১৫ লাখ যানবাহন চলাচল করে তার প্রায় এক তৃতীয়াংশেরই ফিটনেস নেই। বিশেষত গণপরিবহণে সম্পৃক্ত বাসগুলোর কোনো ফিটনেস নেই। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে আনার যে উদ্যোগ, তাতেও তেমন কোনো সাফল্য নেই। ইদানীং ঢাকায় বেশ কিছু ফ্লাইওভার চালু হয়েছে, গাড়ীগুলোকে যে জন্য উঁচুতে উঠতে হয়। কিন্তু এই গাড়ীগুলোতে উঁচুতে উঠার ইঞ্জিন ক্যাপাসিটি না থাকার কারণে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া নির্গত হয় বায়ু দূষণ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন।

বাংলাদেশে মৃত্যুর ১০ টি কারণের ৫টিই হলো বায়ূ দূষ জনিত সৃষ্ট। এলার্জিসহ নানা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া, এমনকি ডায়াবেটিস বাড়ার পেছনেও ডাক্তাররা আজকাল বায়ু দূষণকে একটি কারণ হিসেবে বলছেন। শীসা এবং পারদের দূষণের ফলে অনেক শিশু মাতৃগর্ভেই আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার মেধার সঠিক বিকাশ হচ্ছে না। অ্যালার্জি, ফুসফুস এ ধরনের রোগ নিয়ে প্রায়ই ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে বলে পরিবারে চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে। কর্মঘণ্টা ব্যহত হচ্ছে, মানুষে কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং এর ফলে জিডিপিতে নেতিবাচক একটা প্রভাব পড়ছে বলেও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করছেন।

বাংলাদশ সরকার বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তার কিছুটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ জিয়াউল হক। তার দাবি, শীত কালে, অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে যে বায়ু দূষণটা হয়, এর প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ভাগ দূষণ হয় ট্রান্সবাউন্ডারি, যা পার্শ্ববর্তী দেশ, মূলত থেকে আসে এবং এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কিছু করণীয় নেই। বাকি যে ৬৫ ভাগ দূষণ তার মূল উৎসগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার। যে জন্য বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২২ জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

জিয়াউল হক বলেন, এতে বেশ আধুনিক কিছু কনসেপ্ট আমরা এখানে নিয়া আসছি, যেমন একটা হলো কোনো এলাকায় যদি বায়ু দূষণটা মারাত্মক পর্যায়ে যায়, ওই এলাকাকে ডিগ্রেডেড এয়ার শেড ঘোষণা করে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে দূষণ কমানোর চেস্টা করা হবে। সরকার ওইটাকে ডিগ্রেডেড এয়ার শেড ঘোষণা করে ওই খানে যদি ইট ভাটা থাকে ইট ভাটা গুলো বন্ধ করে দেওয়া, বা অন্য কোনো এয়ার পলিউটিং অ্যাক্টিভিটি থাকলে বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হবে। ইন্ডস্ট্রির ক্ষেত্রে কোনো ইন্ডস্ট্রি যদি বায়ু দূষণ বেশি করে সেই ইন্ডস্ট্রির বিপক্ষে আলাদাভাবে ব্যবস্থা নেওয়া। তাদের মিটিগেশন প্ল্যান জমা দেওয়ার জন্য বলা বা সময়সীমা বেধে দেওয়া, পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা সেটা তৈরি করবে। এসব বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের চেস্টা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

অবৈধ ইটের ভাটা বন্ধে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের একটা সংস্থা উচ্চ আদালতে অনেকগুলো রিট করেছে। তাতে বেশ কিছু সাফল্য এসেছে বলে সংস্থাটির আইনজীবি মনজিল মোর্শেদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। অবৈধ ইটের ভাটা বন্ধের ব্যাপারে প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তবে চূড়ান্ত সফলতা এখনো আসেনি। এটা আরো সময় লাগবে’।

দূষণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে চীনকে উদাহরণ হিসেবে মানছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। ২০১৩ সালে ‘দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে চীন। এর ফলে গত এক দশকে চীনের দূষণ কমেছে ৪২.৩ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এরকমই একটা যুদ্ধ প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র: ডিডাব্লিউ

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.