ওয়ান ব্যাংকে ব্যাপক ঋণ অনিয়ম

ব্যাপক ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের ওয়ান ব্যাংক। গত ডিসেম্বরে ওয়ান ব্যাংককে ‘দুর্বল’ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগ্রাসীভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। এক্ষেত্রে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরামর্শ মানা হচ্ছে না। দেখা হচ্ছে না ঋণের মান। এর ফলে হু হু করে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন বছরে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮৩১ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, সুশাসনের ঘাটতিসহ বেশ কয়েকটি কারণে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ওয়ান ব্যাংককে ‘দুর্বল’ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরে ব্যাংকটিতে নিবিড় তদারকির জন্য সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির প্রতিটি সভার আগে সমন্বয়ক ব্যাংক থেকে পাঠানো স্মারক পর্যালোচনা করে এমডিকে নিজের মতামত ও পরামর্শ দেন। সমন্বয়ক নিয়োগের পর পর্ষদের বৈঠক হয় গত ২৩ জানুয়ারি। এ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটি সমন্বয়কের অনেক পরামর্শই মানেনি।

যোগাযোগ করা হলে ওয়ান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুর মফিজ অর্থসূচককে বলেন, এসব বিষয়ে যা বলার তা আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছি। আপনাদের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি থাকার পরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এক হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ সুবিধা দিয়েছে ওয়ান ব্যাংক। নতুন সুবিধা দেওয়ার আগে পুরনো সমস্যা সমাধানেরও পরামর্শ দেয় সমন্বয়ক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই পরামর্শ উপেক্ষা করে ব্যাংকটি। ঋণ অনিয়মে সৃষ্টি হয়েছে বিপত্তি। এতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে দুর্বল এই ব্যাংকটিকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওয়ান ব্যাংকের সমস্যা সমাধানে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রতিটি সমস্যার সমাধানে আলাদাভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেয় ব্যাংকটি। এরপরেও প্রতিশ্রুতি পরিপালনে ব্যাপক অনিহা দেখিয়েছে তারা। অনিয়ম করলে যেকোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওয়ান ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার গ্রাহক নোমান টেক্সটাইল মিলস। এই গ্রাহকের ক্ষেত্রে সমন্বয়কের পরামর্শ ছিলো, বকেয়া ১৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আদায় এবং ৭০ কোটি টাকার ওভার ড্রাফট (ওডি) সুবিধা ৫০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার আগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে গ্রাহকের ঋণ নবায়ন করতে হবে। তবে সমন্বয়কের পরামর্শও ওয়ান ব্যাংক আমলে নেয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সমন্বয়কের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওয়ান ব্যাংকের গুলশান নর্থ শাখার গ্রাহক প্রসাধনী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রিমার্ক এইচবি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধকি সম্পত্তির অতিরিক্ত না দেওয়ার পরামর্শ দেন সমন্বয়ক। এখানেও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা না মেনে রিমার্ক এইচবিকে ১৩ কোটি টাকার সম্পদ জামানতের বিপরীতে ৬৭ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়।

এদিকে ব্যাংকটির উত্তরা শাখার গ্রাহক ডার্ড কম্পোজিট টেক্সটাইলে একটি সিন্ডিকেটেড ঋণ রয়েছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত ফান্ডেড-নন-ফান্ডেড মিলে ওয়ান ব্যাংকে গ্রুপটির ঋণ ছিল ২৯৩ কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তিতে এখনও ব্যাংকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রাহক এর আগে আটবার সময় নিয়েও তা করেননি। এখন আরও ছয় মাস সময় চেয়েছে। তবে এতে আপত্তি জানান সমন্বয়ক। একইসঙ্গে বন্ধকি সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যাংককে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন সমন্বয়ক। তবে সেই পরামর্শ না মেনে ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির অনুকূলে ৩২৫ কোটি টাকার ঋণ নবায়নে যথাযথ জামানত সংরক্ষণ এবং ঋণের সর্বশেষ ‘শ্রেণিমান’ নিশ্চিত হওয়ার পরামর্শ দেন সমন্বয়ক। এই ঋণের ক্ষেত্রেও পরামর্শ না মেনে অনুমোদন দেওয়া হয়। ওয়ালটন হাই-টেকের আগের নেওয়া ঋণ খেলাপি (সাব স্ট্যান্ডার্ড) হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ নবায়নের কোনো সুযোগ নেই। নিয়মিত ঋণেই কেবল নবায়ন করে সময় বাড়ানো যায়।

এছাড়া ব্যাংকটির গুলশান-১ শাখার গ্রাহক পূর্বাণী ইয়ার্ন ডায়িং ও পূর্বাণী সিনথেটিক স্পিনিংয়ের মাত্র ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার সহায়ক জামানতের বিপরীতে ৫৮ কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করা হয়। নারায়ণগঞ্জ শাখার গ্রাহক পিএন এন্টারপ্রাইজের মাত্র ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকার জামানতের বিপরীতে ২৫ কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত জামানত নিশ্চিতের পরামর্শ দেন সমন্বয়ক।

সূত্র আরও জানায়, বনানী শাখার গ্রাহক ন্যাশনাল পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজের ঋণ ২৪ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ কোটি টাকা করার আবেদন এসেছে। এ প্রতিষ্ঠানের আগের বকেয়া ২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা সমন্বয়ের পর প্রস্তাব অনুমোদনের পরামর্শ দেন সমন্বয়ক। সমন্বয়কের এসব পরামর্শ যথাযথভাবে পরিপালন হচ্ছে কিনা, প্রতিবেদনে তা যাচাই করতে বলা হয়েছে। এছাড়া জামানত ছাড়াই এডিসন পাওয়ার বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি ছাড়া কেবল করপোরেট গ্যারান্টি ও ব্যক্তিগত গ্যারান্টির বিপরীতে এ ঋণকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে মত দেন সমন্বয়ক।

অর্থসূচক/সুলাইমান/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.