অর্থনীতিতে বৈশ্বিক প্রভাব কমাতে দরকার বাণিজ্য বহুমুখী: সিএসই চেয়ারম্যান

অর্থনীতিতে বৈশ্বিক প্রভাব কমাতে দরকার বাণিজ্য বহুমুখী: সিএসই চেয়ারম্যান

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক সমস্যার প্রভাব কমাতে বহুমুখী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। একটি দেশের উপর নির্ভরতা কমাতে সরকারের বাণিজ্য সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনতে হবে। একইসঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর দেশের নির্ভরতা কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোতে বিনিয়োগ করতে হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম।

শনিবার (১৮ মার্চ) ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) আয়োজিত “কোভিড পরবর্তী প্রভাব এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং করনীয়” শীর্ষক সিপিডি সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

এসময় তিনি বলেন, সরকারকে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সহায়তা প্রদান করা দরকার। যারা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। করোনার সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিমুখী শিল্পকে সরকারের সহায়তা প্রদান করতে হবে। এছাড়া কোনো একটি দেশের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমাতে সরকারের বাণিজ্য সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনতে হবে। একইসরঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর দেশের নির্ভরতা কমাতে সরকারকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোতে বিনিয়োগ করতে হবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী সিপিডি সেমিনার আয়োজনের জন্য আইসিএসবিকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, করোনা শুরু আগে আমাদের অর্থনীতির গ্রোথ অনেক ভালো ছিলো। এরপরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়তে থাকে দেশের অর্থনীতিতে। করোনা জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছিলো। তবে মহামারির সময় আমরা ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধা কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অধীনে নিয়ে আসা গেছে। এর ফলে অনেক বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এখনই দেশের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। যুদ্ধের শুরুতে তেলের দাম বেড়েছিলো। তবে কয়েকদিন ধরে তেলের দাম আবার কমে আসছে। এটি অনেকটা স্বস্তির। রাশিয়া থেকে সার সহ আরও অনেক পণ্য আমরা আমদানি করি। সামনের দিনগুলোতে এসব আমদানি পণ্যে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।

সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড.আতিউর রহমান “কোভিড পরবর্তী প্রভাব এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং করনীয়” শীর্ষক একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইসিএসবি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ এবং প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সাব কমিটির চেয়ারম্যান।

বিডার চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ একটি বিশাল সম্ভাবনার দেশ। আমরা এমন একটি ভবিষ্যতের পথে যা আজকের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ভাল হবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশের ভিশন ২০৪১ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের লক্ষ্য এবং কৌশল নির্ধারণ করে। এমডিজির সাফল্য ও এসডিজি অর্জনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এসেছে। গত ১৫ বছরে সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বের যেকোনো স্থানে দ্রুততম দারিদ্র্য হ্রাসের সাক্ষী হয়েছে। আমাদের ব্যয়কে যুক্তিযুক্ত করা উচিত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং টেকসই স্থায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বিডা বিনিয়োগ প্রচার, বিনিয়োগ সহজীকরণ, বিনিয়োগ নিবন্ধন, পলিসি এডভোকেসি বিষয়ে কাজ করছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে বিশ্বব্যাপী মন্দার সম্মুখীন হচ্ছে। যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন বিশ্ব মাত্র করোনা মহামারির কারণে তৈরি পতন থেকে পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছিলো। এছাড়া সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এমন একটি সিপিডি সেমিনার আয়োজনের জন্য আইসিএসবিকে ধন্যবাদ জানান লোকমান হোসেন মিয়া।

আতিউর রহমান বলেন, করোনার চাপের পরে দেশের অর্থনীতিতে আঘাত করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সারাবিশ্ব এখন অনিশ্চিত সময় পার করছে। দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নেতিবাচক। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বড় সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কোনো ব্যাংক যেনো লিকুইডিটি সমস্যায় না পড়ে সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংককে খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমান এই কঠিন সময়ে যারা দারিদ্র্যের স্বীকার হয়েছেন তাদের সামাজিকভাবে সহযোগিতা করা দরকার। তবে এক্ষেত্রে অনেক বেশি পরিমাণে টাকা ঢেলে দেওয়া উচিত না। খেয়াল রাখতে হবে কোনো ব্যাংক যেনো লিকুইডিটি সমস্যায় না পড়ে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, যা বর্তমান প্রায় ২ হাজার ৮০০ ডলার। সম্পদের বিচক্ষণ বরাদ্দ এবং উদ্ভাবন ও টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া কৃষি বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির মূল রক্ষা ব্যবস্থা। দেশের কৃষি খাত আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সময়ে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকহারে বাড়ছে। একইসঙ্গে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সবকিছুই হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে। বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার ইতিহাস খুব বেশি ভালো না। আমরা চাইলেই বিদেশি সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নিতে পারি না। সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুতি দিলেও ঋণ পেতে কিছুটা সময় লাগে। একইসঙ্গে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। এজন্য সরকারকে ব্যাংক খাত থেকে অনেক বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যাপক সহযোগীতা করছে। দেশ কৃষিক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরেও দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই। বিনিয়োগ-চালিত শিল্প উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। আমাদের আগেই ডিজিটাইলজড হওয়া মহামারির মধ্যে উপকার বয়ে এনেছে। বাংলাদেশ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধারের জন্য সঠিক পথে রয়েছে। অর্থনীতি স্থিতিস্থাপকতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত। দুর্যোগ কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে আমরা আত্মবিশ্বাসী। তবে আগামী দিনে আমাদের সতর্ক পদক্ষেপের প্রয়োজন।

ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট আসাদ উল্লাহ তার স্বাগত বক্তব্যে সকলকে আইসিএসবির ফ্ল্যাগশিপ লার্নিং প্রোগ্রাম সিপিডিতে যোগদানের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এই ধরনের সিপিডি প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইনস্টিটিউটের সদস্যরা সাম্প্রতিক পরিবর্তন ও হালনাগাদ জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। প্রধান অতিথিকে আইসিএসবি এবং বিডা-এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। এই সমঝোতা স্মারকের মধ্যমে আইসিএসবি বিডাকে পেশাদার সহায়তা, প্রশিক্ষণ, পেশাদার দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করতে পারবে। একইসঙ্গে আইসিএসবির সদস্য ও বিডার কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ, পেশাগত উন্নয়ন এবং নলেজ শেয়ারিং কার্যক্রম সহজ হবে।

সেমিনারে নুরুল আলম বলেন, ডক্টর আতিউর রহমান এবং জনাব আসিফ ইব্রাহিম অত্যন্ত চিন্তাশীল আলোচনা করেছেন যা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। করোনা পরবর্তী এবং রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এবং মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রায় ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। তাদের ক্রয় ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হারাচ্ছে। মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে থাকার জন্য চলে যাচ্ছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যদ্রব্য আকাশচুম্বী হয়ে মধ্যবিত্ত মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স। সরকারের এখন সুশাসন জোরদার, এমএফএসের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

অর্থসূচক/এমএইচ/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.