বাংলাদেশের বাজেটের দ্বিগুণ টাকা হারালেন গৌতম আদানি

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ এ শেয়ার মূল্য নিয়ে কারসাজি সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে ভারতের বিতর্কিত ব্যবসায়ী গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেই চলেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, খোদ উদ্যোক্তারা নানা কারসাজির মাধ্যমে আদানির বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়েছেন। অন্যদিকে আদানি গ্রুপ বিপুল পরিমাণ ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত। তাই এই গ্রুপের কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যৎ যথেষ্ট হুমকীর মুখে।

হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট পরবর্তী ১০ দিনে আদানি গ্রুপের সম্পদমূল্য কমেছে ১১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২ লাখ ৭৮ হাজার ৫০৯ কোটি (ভারতীয় মুদ্রায় ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৪০১ কোটি রুপি)। যা বাংলাদেশের ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ।
খবর আনন্দবাজার পত্রিকার
এদিকে, বাণিজ্য এবং অর্থনীতি বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘ফরচুন’এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার আগে আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থাগুলির মোট সম্পত্তি ছিল ২১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার বা ২৩ লাখ ৫১ হাজার ১৫৮ বাংলাদেশি টাকা প্রায়। ১০ দিনে তা এসে ঠেকেছে ৯ হাজার ৯০০ কোটি ডলার বা ১০ লাখ ৭২ হাজার ৬৪৮ বাংলাদেশি টাকা প্রায়।
অর্থাৎ, ১০ দিনে নিজের মোট সম্পদের ৫০ শতাংশেরও বেশি হারিয়েছেন আদানি পরিবার। আর এ লোকসানের কারণেই ভারত এবং এশিয়ার সব থেকে ধনী ব্যক্তি হওয়ার তকমাও হারিয়েছেন গৌতম আদানি। এর ফলে এক ধাক্কায় বিশ্বের সেরা ধনকুবেরদের তালিকা থেকেও অবস্থান বিচ্যুতি হয়েছে গৌতম আদানির। আমেরিকার এক পত্রিকা অনুযায়ী, শুক্রবার বিশ্বের সব থেকে ধনীদের তালিকায় ২২ নম্বরে রয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আদানি এই তালিকায় ছিলেন ১৬তম স্থানে।
২৪ জানুয়ারি রিপোর্ট প্রকাশ্যে এনে হিন্ডেনবার্গ দাবি করেছে, এক দশক ধরে শেয়ার বাজারে বিভিন্ন কারসাজি করে চলেছে আদানি গোষ্ঠী। আর সেই কারণেই নাকি আদানিদের অবস্থা এত রমরমা। আদানিদের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের অভিযোগও আনে এই সংস্থা। হিন্ডেনবার্গের সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে আদানি গোষ্ঠী।
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের জেরে কার্যত ধস নেমেছে আদানি গোষ্ঠীর ১০টি সংস্থার শেয়ারে। কোনও সংস্থার শেয়ারে ১৭ শতাংশ পতন হয়েছে, তো কোনও সংস্থার শেয়ারদর এক ধাক্কায় ৫১ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
গত বুধবার চলতি অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের দিনেই নতুন শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া (এফপিও) বাতিল করে দেয় আদানি গোষ্ঠী। প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার ওই এফপিও বাতিলের পর আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দর আরও নেমে গিয়েছে।
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশের প্রথম ৯ দিনের হিসাব অনুযায়ী শেয়ার বাজারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ‘আদানি টোটাল গ্যাস’-এর। সেই সংস্থার শেয়ার দর কমেছে ৫১ শতাংশ।
১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ‘আদানি এন্টারপ্রাইসেস’-এর শেয়ারের দাম ৩৮ শতাংশ কমেছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকা। ‘আদানি ট্রান্সমিশন’ ক্ষতির নিরিখে তৃতীয় স্থানে। গত ৯ দিনে শেয়ারের দাম ৩৭ শতাংশ কমেছে এই সংস্থার। প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি।
তালিকায় এর পরেই রয়েছে ‘আদানি গ্রিন এনার্জি’। এই সংস্থার শেয়ারের দাম ৪০ শতাংশ কমেছে। শেষ ৯ দিনে ‘আদানি পোর্টস অ্যান্ড সেজ়’-এর শেয়ার পড়েছে ৩৫ শতাংশ।
‘আদানি পাওয়ার’-এর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সোয়া ১ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই সংস্থার শেয়ারের দাম গত ৯ দিনে ২৩ শতাংশ কমেছে। তালিকায় রয়েছে ‘অম্বুজা সিমেন্টস’ এবং ‘আদানি উইলমার’-ও। ২৪ জানুয়ারির পর থেকে ‘অম্বুজা সিমেন্টস’-এর শেয়ারের দাম প্রায় ৩৩ শতাংশ কমেছে। ‘আদানি উইলমার’-এর শেয়ারে পতন হয়েছে ২৩ শতাংশ।
শেয়ারে ক্ষতির মুখে রয়েছে আদানিদের সদ্য মালিকানা পাওয়া সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিও। শেষ ৯ দিনে তাদের শেয়ারের দাম ১৭ শতাংশ কমেছে।
কিন্তু আদানি গোষ্ঠী যে এই পরিস্থিতির মুখে পড়তে চলেছে, সেই ‘অশনি সঙ্কেত’ অনেক আগেই দিয়েছিল অন্য এক সংস্থার রিপোর্ট।
গত বছরের অগস্ট মাস নাগাদ ব্যবসায় পাল্লা দিয়ে মুকেশ অম্বানীকে টপকে দেশের সব থেকে ধনী ব্যক্তির তকমা পেয়েছিলেন গৌতম। কিন্তু তখনই ‘ক্রেডিট সাইট’-এর এক সমীক্ষায় উঠে আসে চমকে দেওয়া তথ্য।
‘ক্রেডিট সাইট’-এর ওই সমীক্ষার দাবি ছিল, আদানি গোষ্ঠীর সাফল্যের চাকচিক্যের পিছনে রয়েছে পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা। আদানির ঋণের পরিমাণ সেই সময়ই প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা হয়ে গিয়েছিল বলেও সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল।
ওই সমীক্ষায় জানানো হয়, গত বছর বিশ্ব বাজারে আদানির ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। এক বছরে এই ঋণের পরিমাণ তো কমেইনি, উল্টো ৪২ শতাংশ বেড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা হয়েছে। এই ঋণের ভার মারাত্মক হতে পারে বলেও সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছিল।
বিভিন্ন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে পা বাড়িয়ে আদানি গোষ্ঠী পৌঁছে গিয়েছে তাপবিদ্যুৎ এবং গ্রিন এনার্জিতেও। আদানির এই রমরমা দেশ-বিদেশের খ্যাতনামী ব্যবসায়ী সংস্থারও নজর কেড়েছে। কিন্তু ‘ক্রেডিট সাইট’-এর ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, ব্যবসা বৃদ্ধি করতে আদানি গোষ্ঠী যে ঋণ নিয়েছে, তাতে বড় বিপদে পড়তে পারে সংস্থা।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছিল, আদানির বিদেশি মুদ্রায় নেওয়া ঋণের পরিমাণও অনেক। সেই সময় এই খবরও ছড়িয়ে পড়ে যে, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) কাছ থেকে নতুন করে প্রায় ১৮.৫ হাজার কোটির ঋণ নেওয়ার আবেদন করেছেন আদানি। এই নতুন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে গ্রিন এনার্জি সংক্রান্ত ব্যবসাও। এর ফলে ঋণের বোঝা আরও বাড়তে পারে বলেও দাবি করা হয়েছিল।
যদিও এলআইসি এবং এসবিআই— উভয় সংস্থা সম্প্রতি বিবৃতি জারি করে জানিয়েছে যে, আদানিদের শেয়ার বাজারে পতনের আঁচ তাদের গায়ে এসে লাগেনি। সংস্থাগুলির লাভেও প্রভাব পড়েনি বলেই জানানো হয়েছিল।
হিন্ডেনবার্গের আনা অভিযোগে কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আদানিরা? আদানিদের পাল্টা অভিযোগ, হিন্ডেনবার্গ স্বল্পমেয়াদি মুনাফার জন্য রিপোর্ট তৈরি করেছে। এই রিপোর্ট ভারতের অগ্রগতিকে রোখার চক্রান্ত বলেও দাবি করে আদানি গোষ্ঠী। এই আক্রমণাত্মক বিবৃতি সত্ত্বেও অবশ্য হাল ফেরেনি। উপরন্তু, হিন্ডেনবার্গের পাল্টা দাবি, জাতীয়তাবাদের আড়ালে প্রতারণা ঢাকা দেওয়া যায় না।
আদানিরাই প্রথম নয়। ২০১৭ সাল থেকে কমপক্ষে ১৬টি আলাদা আলাদা গোষ্ঠী এবং সংস্থার বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের বা ব্যবসায় নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করার রিপোর্ট প্রকাশ্যে এনেছে।
২০২০ সালের বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা নিকোলার বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ আনে হিন্ডেনবার্গ। নিকোলার প্রতিষ্ঠাতা ট্রেভর মিল্টন দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর সেই সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যায়।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.