ডিসিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ২৫ নির্দেশনা

জেলা প্রশাসকদের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণসহ ২৫টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি শুধু মাত্র প্রয়োজনীয় প্রকল্পই গ্রহণ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের গ্রহণের ক্ষেত্রে যেটা আমাদের এখনি প্রয়োজন শুধুমাত্র সেগুলোই গ্রহণ করতে চাই। কোভিড-১৯ কালিন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় সারাবিশ্ব এখন হিমসিম খাচ্ছে। অনেক উন্নত দেশও অর্থনৈতিক মন্দার দেশ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই আমাদের যেন সেটা করতে না হয় সেজন্যই আমরা কৃচ্ছতা সাধনের ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলেছি এবং সে ব্যাপারেও আপনারা সচেতন থাকবেন।’

মঙ্গলবার শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ের (পিএমও) শাপলা হলে তিন দিনব্যাপী বার্ষিক জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২৩ উদ্বোধনকালে তিনি একথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিসিদের বিবেচনা করতে হবে যখনই কোন প্রকল্প নেয়া হয় সেটা ঐ এলাকার জন্য কতটুকু কার্যকর। এতে মানুষ কতটুকু লাভবান হবে এবং অপচয় কতটুকু বন্ধ করা যায়, সেদিকে আপনাদের নজরদারি থাকা উচিত। যেহেতু একটা জেলার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। স্বাভাবিকভাবে এগুলো আপনারা দেখবেন। কারণ, যত্রতত্র শুধু পয়সা খরচের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা আমি পছন্দ করি না।

সারাদেশে ইভিএম কার্যকরী করতে ৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হওয়ায় পরিকল্পনা কমিশন থেকে সেটা বাদ দেয়ায় বিরোধী দলের ব্যঙ্গোক্তি ‘ও বাংলাদেশের আর্থিক সংকট’ এর উল্লেখ করে তিনি বলেন, আর্থিক সংকট অবশ্যই সারা বিশ্বব্যাপী আছে। আমাদেরও আছে। কিন্তু এমন পর্যায়ে নাই যে আমরা চলতে পারবো না। আমাদের অগ্রাধিকার আমাদেরই বিবেচনা করতে হবে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করাই আমাদের অগ্রাধিকার।

সরকার প্রধান বলেন, ‘মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে আমাদের কৃষি উৎপাদন যাতে বাড়ে সেজন্য যা খরচ লাগে আমরা করবো। অন্য দেশ যা করেনি আমরা বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছি। আমি আমাদের জেলা প্রশাসকবৃন্দকে একটা কথাই বলবো আমি আসার (ক্ষমতায়) পর আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মাঝে এই যে জনমুখী বা জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বা জনগণকে সেবা দেয়ার যে একটা আন্তরিকতা থাকা উচিত সে আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়েছে, এই পরিবর্তন আমি দেখেছি আপনাদের মাঝে। আর সেটা যদি না হতো বাংলাদেশের উন্নয়নের যতটুকু কাজ আমরা করতে পেরেছি বা সফলতা পেয়েছি সেটা সম্ভব হতো না। কারণ, আমরা জনপ্রতিনিধিরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই ক্ষমতায় আসি।

তিনি বলেন, ’৭৫ এর পর থেকে উর্দি পরে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণার মত দুঃসহ অবস্থা দেশে বিরাজমান ছিল, যদিও ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে ২০২২ পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু প্রচেষ্টা চলেছে সেখানেও এবং মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ, অগ্নিসন্ত্রাস বা গাছকাটা মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে, কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না হলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। এ কারণে আমদানী নির্ভর পণ্য মূল্য এবং পরিবহন ব্যয় উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি সর্বক্ষেত্রে কৃচ্ছতা সাধনের আহবান করেছি। কৃচ্ছতা সাধন করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটা পরিহার করতে হবে-আর এভাবে যদি আমরা চলতে পারি তাহলে একটু ধীরগতিতে হলেও উন্নয়নের গতিধারা আমরা অব্যাহত রাখতে পারবো।

তিনি আরও বলেন, করোনায় চিকিৎসা, টিকাসহ সুরক্ষার জন্য পানির মতো টাকা খরচ হয়েছে। সেটা আমরা করেছি। আমাদের এখন যেটা জরুরি, সেটাকেই অগ্রাধিকার দেবো। আমরা কতকাল আমদানি নির্ভর থাকবো? আমরা নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে নিজেরাই উৎপাদন করবো। এক সময় তো ভারতীয় গরু ছাড়া আমাদের কোরবানিই হতো না। এখন হচ্ছে না? হচ্ছে। আমরা এখন নিজেদের উৎপাদনে ওপর নির্ভর।

এসময় কার্গো বিমান কেনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেদের জন্য কার্গো বিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। কিন্তু অর্থনৈতিক এ অবস্থায় কিনতে পারছি না। ভবিষ্যতে কিনবো পরিকল্পনা আছে। এ সময় জাতির পিতার ভাষণের উদ্বৃতি তুলে ধরে কর্তব্য পালনে সরকারি কর্মচারীদের আরো আন্তরিক হবার আহবান জানান।

জাতির পিতা ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনাদের জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে’- বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, এটাই বাস্তব কথা যে, আপনাদের জনগনের সেবক হতে হবে। আমরাও যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাই বা আপনারা সরকারি আমলা হিসেবে যে সুযোগ-সুবিধা পান এগুলোর অবদান কিন্তু জনগনের। কারণ, জনগণের অর্থ এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকাতেই সবকিছু চলে। এর জন্য আমরা একেবারে তৃণমূল থেকে জনগণকে শক্তিশালী করে আনতে চাই। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যেকটি গ্রামের মানুষকে আমরা শহরের সুবিধা দিয়ে দিতে চাই। এতে শহরমুখি প্রবণতা কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে অর্থনৈতিক প্রাণ চাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে।

শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করেছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে প্রমাণ করেছে যে, সে প্রকল্পে কোন দুর্নীতি হয় নাই। সকলের মাঝে এমন একটা মানসিকতা ছিল যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারবো না। তাদের কথা শুনেই আমাদের সব করতে হবে হবে কেন? তারা আমাদের দেশ সম্পর্কে কতটুকুই বা জানে। কাজেই আমাদের নিজেদের চিন্তা নিজেদেরই করতে হবে। আর এই একটা সিদ্ধান্তে পদ্মা সেতু সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক মহলে বৃদ্ধি পেয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার ঐতিহামিক ৭ মার্চের ভাষণের মূল মন্ত্র কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা’ এর উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশকে যে এখন আন্তর্জাতিক বিশে^র কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবেনা, এটা সকলে বুঝে গেছে।

ডিসিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ২৫ দফা নির্দেশনা:

১.খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পতিত জমিতে ফসল ফলাতে হবে। কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে সে লক্ষে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে;
২.নিজেরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং জনগণকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৩.সরকারি অফিসসমূহে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘেœ যথাযথ সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সেবা প্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত;
৪.সরকারি তহবিল ব্যবহারে কৃচ্ছতা সাধন করতে হবে;
৫.এসডিজি স্থানীয়করণের আওতায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে;
৬.দেশে একজনও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তসহ সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। জমি ও ঘর প্রদানের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে;
৭.শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে;
৮.কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রসমূহ যেন কার্যকর থাকে তা প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান করতে হবে;
৯.শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীল চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
১০. নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে;
১১. পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে;
১২. সরকারি দপ্তরসমূহের ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। নিজ নিজ জেলার সরকারের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সাফল্য ওয়েবসাইটে তুলে ধরতে হবে;
১৩. জনসাধারণের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধে উদ্যোগ নিতে হবে;
১৪. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন কোনোভাবেই অবনতি না হয়, সেদিকে নজরদারি জোরদার করতে হবে;
১৫. মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে;
১৬. মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে। নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ যাতে জঙ্গিবাদে জড়িত না হয় সে জন্য সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। যুব সমাজকে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রাখতে হবে;
১৭. বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে;
১৮. বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে, কৃত্রিম সঙ্কট রোধকল্পে ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে;
১৯ সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে;
২০. নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্লুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে;
২১. বজ্রপাত প্রবণ এলাকায় তালগাছ রোপণ করতে হবে;
২২. পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে;
২৩. জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যসমূহের প্রচার, বিপণন এবং ব্রান্ডিং করতে হবে;
২৪ জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে সেবার মনোভাব নিয়ে যেন সরকারি দপ্তরগুলো পরিচালিত হয়, সে লক্ষে মনিটরিং জোরদার করতে হবে;
২৫. জেলার সকল সরকারি দপ্তরের কার্যক্রমসমূহ যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ তথা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আপনাদের ব্রতী হতে হবে।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.