‘বিপাকে পড়ে ফ্লোর প্রাইজের কথা চিন্তা করতে হয়েছে’

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, উন্নত দেশগুলোর স্টক এক্সচেঞ্জে ৯০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, বাকী ১০ শতাংশ রিটেইল। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। আমাদের বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ইনভেস্টর থাকলে ফ্লোর প্রাইজ নিয়ে আমরা চিন্তাও করবো না। আমি আইএসকোর একজন কর্মকর্তা, বিপাকে পড়ে আমাকে ফ্লোর প্রাইজের কথা ভাবতে হয়েছে। শুধুমাত্র রিটেইল ইনভেস্টরদের কথা ভেবে কমিশনকে ফ্লোর প্রাইজের কথা চিন্তা করতে হয়েছে।

সোমবার (৫ ডিসেম্বর) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ (Prospects and Challenges of Bangladesh capital market)’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যখন এসেছি তখন ছিলো করোনা, একদম বন্ধ মার্কেট। আমরা এসেই কাজ করেছি কিভাবে পুঁজিবাজারকে চালু করা যায়। বন্ধ মার্কেটকে পুনরায় চালু করতে আমরা ঠিকই প্রতিদিন অফিস করেছি। কিন্তু আমরা ছাড়াও মার্কেটে যারা কাজ করে, যারা মধ্যস্ততাকারী আছেন তারা অফিস করছিলেন না। তারা ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন না। তার পরেও আমরা মার্কেটকে সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্টে নিয়ে এসেছি আমাদের সময়ে।

এসময় বিনিয়োগ শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিনিয়োগ শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগারী এবং বাজার উভয়ের জন্য। সেজন্য স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে বিনিয়োগ শিক্ষা কিভাবে যুক্ত করা যায় সে ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচকের বক্তব্যে ডিএসই চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে লেনদেন ও সূচক অনেক বেড়েছে। একইসঙ্গে মার্কেট ক্যাপিটালও বেড়েছে। গত বছর বাজার মূলধল ছিলো ৫ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। বর্তামনে এর পরিমাণ সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকা। বর্তমান কমিশন গভর্নেন্স বেশ মনযোগী হয়েছে। এটিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত ২০১৯ সালে ৮ শতাংশের কাছাকাছি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হয়েছিলো। সেসময় বিভিন্ন সংকট দেখা দেয়। সংকটের মধ্যেও ৫ শতাংশের উপরে গ্রোথ হয়েছে। এছাড়া সারা দেশের মানুষের হাতে টাকা আছে। একইসঙ্গে রয়েছে শক্তিশালী উদ্যোক্তা। বাজার উন্নয়নে সরকারের দিক থেকে সহায়তা অব্যাহত রয়েছে।

এছাড়াও তিনি বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে জেনে বুঝে বিনিয়োগ করা লোক অনেক কম। একইসঙ্গে খাতটিতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বাজারে গুটিকয়েক মানুষের পদচারনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও অনেক কম। এছাড়া পলিসি মেকারে আরও বেশি মনযোগ বাড়াতে হবে।

এসময় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য ব্যাংক সঠিক জায়গা নয়। তাই ভবিষ্যত অর্থনেতিক লক্ষ্য অর্জনে পুঁজিবাজার ছাড়া কোনও গতি নেই। দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ডিএসই, সিএসই ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সবাই একসঙ্গে কাজ করছি। বর্তমানে আমরা অর্থনৈতিক ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একটি দেশের প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থসূচকের সম্পাদক, সিএমজেএফের সভাপতি এবং ইআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগাতেই হবে। বিশেষ করে আমরা ২০৪১ সালের যে ভিশন নিয়ে কাজ করছি তা বাস্তবায়নে যে পরিমান বিনিয়োগ প্রয়োজন তা একা ব্যাংকের পক্ষে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। ব্যাংকের উপর অতি নির্ভরশীল হলে যে কি হয় তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। সর্বশেষ খেলাপি ঋণের যে তথ্য আমরা দেখেছি, প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা করে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এই সমস্যা থেকে বের হতে হলে আমাদের দরককার গতিশীল পুঁজিবাজার। আর গতিশীল পুঁজিবাজার করতে হলে সেকেন্ডারি মার্কেটকে ভাইভ্রেন্ট করতে হবে। সেকেন্ডারি মার্কেট যদি ভাইভ্রেন্ট না থাকে তাহলে মূল মার্কেটেও তার নেতিবাচক প্রভাব পরে। ভালো একটা কোম্পনি যখন বুক-বিল্ডিং বা অন্য যে কোন পদ্ধতিতে বাজারে আসে, তখন তারা চায় যে তাদের শেয়ারের ভালো প্রাইসিং হোক। সেই প্রাইসিং টা আবার নির্ভর করে বাজারের সামগ্রিক পরিস্থিতির উপর। যেমন সেকেন্ডারি মার্কেট ভাইভ্রেন্ট কিনা, যৌক্তিক দামে শেয়ার কেনা-বেঁচা হচ্ছে কিনা। যখনি বাজারে এরকম পরিবেশ থাকবে তখনি বাজারে নতুন উদ্যোক্তা আসবে এবং উদ্যোক্তা আসলে নতুন বিনিয়োগকারীও আসবে। মন্দা বাজারে কোন বিনিয়োগকারী আসেনা। বাজার ভাইভ্রেন্ট থাকলে মানুষ বিনিয়োগে আগ্রহী হয়।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোর সংগঠন বিএপিএলসির সাবেক সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, পুঁজিবাজারের যদি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা, ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে চায়, তারা বিনিয়োগ করবে কীভাবে? তাদের কাছে তো টাকা নাই। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংক সময় বেঁধে দেয়। যে মুনাফা হয় তা প্রফিশন বিল্ড আপ করতেই চলে যায়। তাহলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবে কীভবে? তিন বছর ধরে বিশ্বের প্রায় সব মার্কেটই ওঠানামা করছে, আমাদের মার্কেটেও তাই হচ্ছে। ধারাবাহিক উত্থান বা পতন প্রত্যাশা করা যায় না।

অন্যদিকে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন- বিএমবিএর সহসভাপতি মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বিভিন্ন ক্রাইসিস মুহূর্তে দেখি, বা মিডিয়াতে আসে, বিভিন্ন ধরনের স্কিম তৈরি করা হয় যে, কারা কত শেয়ার কিনবে বা বিনিয়োগ করবে। এই ডিমান্ড ড্রিভেন পলিসি খুবই শর্ট লিড। এটা অন্যান্য জায়গায় কাজ করে না।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মেরিট বেসড বা ভ্যালু বেসড ইনভেস্টমেন্ট হয় না। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মানসিকতা থাকে না। স্পেকিউলেটিভ ইনভেস্টমেন্ট হয়। কারণ যখন কেউ দেখে রাতারাতি কোনো শেয়ারের ভ্যালু বেড়ে যাচ্ছে। তখন এই স্পেকিউলেশন প্রবৃদ্ধি জেগে ওঠে। সবাই প্রাইস গেই করতে চায়, লং টার্মে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না।’

এদিন সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি সারমিন রিনভী।

এসময় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান, চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) আসিফ ইব্রাহিম, মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিরুজ্জামান, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন বিএপিএলসির সাবেক প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.