ইসলামী ব্যাংকের ঋণ দেওয়ায় সম্পৃক্তদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী চার মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট তিনটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এই তালিকা দাখিল করতে বলা হয়েছে।

রোববার বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াত লিজুর হাইকোর্ট বেঞ্চ গত নভেম্বরে ৩টি ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। বেঞ্চ এস আলম গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা দিতে বলেছে।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক আদালতকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার আবেদন করেন।

এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে এ বিষয়ে তদন্ত করে ৫ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

ঋণ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তায় কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন আদালত। আগামী ৪ সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। অর্থ, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুদক চেয়ারম্যান, বিএফআইইউ ও সিআইডি প্রধানদের এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে পত্রিকায় যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এ বিষয়ে কোর্ট আদেশ দিয়েছেন, আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংবাদের সত্যতা যাচাই করার দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউকে তদন্ত করে আগামী ৫ এপ্রিল প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত। ঋণ নেওয়ার বিষয়ে এস আলম গ্রুপকেও জানাতে বলা হয়েছে। আদালত বলেছেন, আমরা কোনো পক্ষ না। আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটা যাচাইয়ের জন্য আদেশ দিচ্ছি। আমরা যেভাবে শপথ নিয়েছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি কোনো বিষয় থাকে সেটা আমরা দেখব।

এদিকে ইসলামী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে রাখা হচ্ছে না পর্যাপ্ত জামানত। এমন তথ্য ফাঁস হতে থাকায় আতঙ্ক বাড়ছে ব্যাংকটির আমানতকারীদের মধ্যে। এদের কেউ কেউ ব্যাংকটি থেকে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ কমছে। শুধু গত নভেম্বর মাসে ব্যাংকটিতে আমানত কমেছে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকে মনিটরিং বাড়ানোয় বেপরোয়া ঋণে কিছুটা লাগাম পড়বে বলে আশা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। আর এখনো ব্যাংকটিতে দেড় লাখ কোটি টাকা আমানত থাকায় আতঙ্কের কিছু নেই বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, আর যাতে কোনো বেনামী ঋণ বিতরণ না হয় সেটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিতরণকৃত ঋণের অর্থ উদ্ধারে মনোযোগ দিলে ব্যাংকটি তার আগের শক্তিশালী অবস্থান ফিরে পাবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ অর্থসূচককে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের উপর একটি পরিদর্শন চলছে। এসব বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানানো হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জামানত ছাড়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়ায় এখন ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যাংকটির আমানত। আতঙ্কিত হয়ে আমানতকারীরা টাকা তুলে নিতে শুরু করেছেন।

চলতি অর্থবছরের ৩০ নভেম্বর এসে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ দাড়িয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। গত ৩১ অক্টোবর শেষেও ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিলো ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যাবধানে ব্যাংকটির আমানত কমেছে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত মাত্র এক মাসে (১৬ অক্টোবর- ১৭ নভেম্বর) নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া গত ছয় মাসে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৬ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শিমুল এন্টারপ্রাইজ, গ্রেইন ক্রপস, নাবা ফার্ম ও নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ৪ হাজার ৪৩৫ কোটির ঋণ দেওয়া হয়। একই সময় রাজশাহীভিত্তিক মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯০০ কোটি, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ১ হাজার কোটি টাকা এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেস নামের প্রতিষ্ঠানকে ৫০০ কোটি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। ঋণ বিতরণ করা অধীকাংশ প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন বলে জানা গেছে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে ঋণের বিষয়ে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেসের ঋণগ্রহীতার বর্তমান ঠিকানায় বড়গাছী, পবা, রাজশাহী ব্যবহার করা হয়েছে। তবে গরমিল রয়েছে পোস্ট কোডে। আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যিনি ঋণ গ্রহণ করেছেন, তার নাম হচ্ছে মোখলেসুর রহমান। ঠিকানায় দেওয়া হয়েছে রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলার পারিলা গ্রাম। অথচ দুর্গাপুর উপজেলায় পারিলা নামে কোনো গ্রামই নেই। পারিলা মূলত রাজশাহীর পাবা উপজেলার একটি ইউনিয়ন। ওই ব্যক্তির পোস্ট অফিস দেখানো হয়েছে দাওকান্দি আর পোস্ট কোড ৬২৪০। যে পোস্ট কোডটি রাজশাহীর দুর্গাপুরের পোস্ট কোড। এছাড়া অস্তিত্বহীন আরেক প্রতিষ্ঠান মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

চলতি বছর ১ থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে আট ধাপে প্রতিষ্ঠানটিকে এ ঋণ দেওয়া হয়েছে। এদিকে চলতি বছর ৬ জুলাই থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের রাজধানীর গুলশান-২ শাখা নাবিল গ্রেইন ক্রপস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ছয় ধাপে ৯৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেয়। ব্যাংকের বিভিন্ন চার্জসহ বর্তমানে এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এসব ঋণের অধিকাংশই বিতরণ করা হয়েছে গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে।

এদিকে ইসলামী ব্যাংকের গুলশান-২ শাখা গত ২৫ এপ্রিল থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত তিন মাসে নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। অস্তিত্বহীন এই প্রতিষ্ঠানটিকে আট ভাগে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়। ইসলামী ব্যাংকের দাবী অনুযায়ী, নাবা এগ্রো ট্রেড নাবিল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তবে গ্রুপটির ওয়েবসাইটে নাবা এগ্রো ট্রেডের নাম নেই। এভাবে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে জামানত ছাড়াই ধারাবাহিকভাবে ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এতে শঙ্কার মধ্যে পড়েছে ব্যাংকটির আমানত। আতঙ্কিত হয়ে আমানতের টাকা তুলে ফেলা হচ্ছে। গত নভেম্বর মাসেই ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমতে দেখা গেছে।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.