দেশে বিনিয়োগে বিদেশি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

বিনিয়োগ ও সোর্সিংয়ের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিতে বিদেশি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের সেরা অনুকূল গন্তব্য। তিনি বলেন, ‘আমরা সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছি। এরফলে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন বিনিয়োগ এবং সোর্সিং-এর জন্য সর্বাধিক অনুকূল গন্তব্য হয়ে উঠেছে। দেশের বিনিয়োগবান্ধব নীতি একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত ও কোটা-মুক্ত সুবিধা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে।’

রোববার বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানীকারক সমিতি (বিজিএমইএ) আয়োজিত ‘মেইড ইন বাংলাদেশ উইক-২০২২’ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এই আহবান জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতে আমি দেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকেও অনুরোধ করছি। আপনারা তাদের প্রযুক্তি, জ্ঞান আপনাদের শিল্প খাতে গ্রহণ করুন। বাংলাদেশের জনগণই আমাদের সাহসের উৎস। জনগণের আর্থসামাজিক উন্নতি হচ্ছে এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার এখন মাথাপিছু আয়। ক্রয় ক্ষমতাও এদেশের মানুষের বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের নিজস্ব বাজার তৈরি হচ্ছে। শুধু রপ্তানী করলেই চলবে না, নিজের দেশের ভেতরেও বাজার সৃষ্টি করতে হবে এবং করোনাকালিন তাঁর সরকার যতটা সম্ভব তৃণমূলে অর্থ বরাদ্দ দেয়া ও সরবরাহ করা যায় সেটা করেছে। এরফলে মানুষের ভেতর হাহাকার আসেনি।

‘আমাদের দেশেও বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ রয়েছে’ উল্লেখ করে সেই সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ের সাথে আমরা যুক্ত হচ্ছি। তাছাড়া আমরা ওটারওয়েজ, এয়ারওয়েজ, রেলসহ সবকিছুতেই উন্নয়ন করে যাচ্ছি। বর্তমানে শুধু আমরা নই, সারা বিশ্বের মানুষ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে করোনার ভয়াবহতায় সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি তার ওপর আজকে শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও আজ অর্থনৈতিকভাবে হিমশিম খাচ্ছে এবং নানা অসুবিধা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তাই আমরা চাই যুদ্ধ বন্ধ হোক।’

তিনি বলেন, করোনা মহামারীর শুরুতে যখন উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই বিপর্যস্ত তখন আমাদের সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ, আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তার কারণে করোনা মহামারী অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আমরা রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য বিশেষ তহবিল, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান, ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের দুঃস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমসহ মোট ২৮টি প্যাকেজের আওতায় অতি স্বল্প সুদে ২ দশমিক ৩৭ ট্রিলিয়ন টাকার ঋণ বরাদ্দ করেছি, যা ২০২২ অর্থবছেরর মোট জিডিপি-এর ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সময়োচিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের ফলে আমরা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সব বাঁধা সফলভাবে উত্তরণ করতে পেরেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য নগদ সহায়তাসহ অন্যান্য সুবিধা আমরা প্রদান করছি। ওয়ারহাউস সুবিধায় বিনাশুল্কে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা; ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খোলার সুবিধা; হ্রাসকৃত শুল্কে মেশিনারিজ আমদানি এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের অনুকূলে ‘এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) থেকে অতি অল্প সুদে কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। যার ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে অর্জিত হয়েছে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর, ২০২২ সময়ে তৈরি পোশাক থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্জিত রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। সুযোগ বা প্রণোদনা অনেককেই দেয়া হয়, কিন্তু তারা সেটা কাজে লাগাতে পারেনা যেটা গার্মেন্টস শিল্প পেরেছে।

তিনি বলেন, আমাদের জিডিপিতে রপ্তানি খাতের অবদান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিগত অর্থবছরে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য ও সেবাকে দীর্ঘমেয়াদি কর প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্রান্ডকে গ্লোবাল ব্রান্ডে পরিণত করার লক্ষ্যে রপ্তানির নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি এবং পণ্যের বৈচিত্রকরণ ও নতুন বাজার তৈরির উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে কর হার সাধারণ কারখানার জন্য ১২ শতাংশ এবং গ্রিন কারখানার জন্য ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে আজ বিশ্বসেরা ১০টি পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে ৯টিই বাংলাদেশে অবস্থিত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পদধ্বনি শুনছি আমরা। যারা শ্রম দেয় তারা আমার বাংলাদেশেরই মানুষ তাদেরকে আমরা আরো উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে চাই । কারণ এখন বিজ্ঞানের কারণে প্রযুক্তির নতুন নতুন আবির্ভাবে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযুক্ত করে দক্ষ মানব সম্পদ আমাদের গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং উদ্যোক্তাও সৃষ্টি করছে। এই ৪র্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানে যে প্রভাব ফেলবে সেজন্য আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করা হয়েছে। আমাদের তৈরী পোশাক শিল্পে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যবস্থা নিতে হবে, সেজন্য আমরা প্রস্তুত, আমরা তৈরি করছি। মানুষের মাথায় আমাদের এই চিন্তাও ঢোকাতে হবে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে হলে আমাদের দেশে-বিদেশে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন পড়বে। তারা যাতে প্রযুক্তি জ্ঞানেও দক্ষ হয় সেজন্য আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি তৈরী পোশাক রপ্তানীকারকদের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি কাপড়ের গুণগত মান বৃদ্ধি এবং শ্রম বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার আহবান জানান।

তিনি আরও বলেন, তাঁর রাজনীতিই হচ্ছে এদেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহেনতি মানুষের জন্য। তাদের কল্যাণই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আমাদের যে বিপুল শ্রমশক্তি রয়েছে তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং মেধা কাজে লাগানোরও ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। আমাদের সাড়ে ১৬ কোটির ওপরে মানুষ এবং তাদের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে হবে। কিন্তু আমরা কারো কাছে ভিক্ষা করে চলতে চাইনা। নিজের খাদ্য উৎপাদন নিজে করবো। সেজন্য ফসলি জমি রক্ষা করা, যততত্র শিল্প গড়ে না তোলা এবং পরিবেশ বান্ধব শিল্প গড়ে তোলার ব্যবস্থাও আমরা নিচ্ছি।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের (বিআইসিসি) হল অফ ফেম-এ ‘কেয়ার ফর ফ্যাশন’ থিম নিয়ে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছে। ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত এটি চলবে। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এর প্রচার করাই এই ইভেন্টের মূল উদ্দেশ্য কারণ। বিজিএমইএ তার মার্কেট শেয়ার ধরে রাখতে এবং বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশী পোশাকের মার্কেট শেয়ার বাড়াতে চায়। সপ্তাহব্যাপী এই মেগা ইভেন্ট গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের অংশীদারদের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি করবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দুটি কফি টেবিল বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করেন, যার ওপর বিজিএমইএ চলতি বছরের শুরু থেকে কাজ করছে। পোশাক রপ্তানীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৪ জন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারককে বিশেষ সম্মাননাও প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ইন্টারন্যাশনাল এ্যাপারেল ফেডারেশন (আইএএইফ) সভাপতি সেম অলটান এবং বিজিএমইএ সিনিয়র সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি বক্তৃতা করেন। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান স্বাগত বক্তব্য রাখেন। দেশের পোশাক খাতের অগ্রগতি এবং নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক পৃথক দুটি ভিডিও চিত্র অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.