পুঁজিবাজারে শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি চক্রের বিরুদ্ধে বিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ, কতটা কার্যকর?

পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দেশের পুঁজি বাজারের আকার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সামনে শুধু ইকুইটি না বন্ড বাজারও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা ব্যাংক নির্ভরতা কমিয়ে পুঁজি সংগ্রহের নির্ভরতার প্রতিক হবে পুঁজিবাজার। জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে অনেক দেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে।

শেয়ারের মূল্য হ্রাস বৃদ্ধি স্বাভাবিক ধর্ম, কোন কোম্পানির ভাল খবর যেমন দাম বাড়ায় আবার খারাপ খবর দাম কমাবে এটাই স্বাভাবিক। আবার এই বাজারে কারসাজি করে শেয়ারের দাম বাড়ানোর কারনে একদিকে এ্কপক্ষ অনেক লাভবান হয়েছে, অন্যদিকে সব হারিয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আর বাজার পড়েছে আস্থা সংকটে। আস্থা সংকট কাটাতেই দ্বিতীয় বারের মত আমাদের পুঁজিবাজারে ৩১ জুলাই ২০২২ তারিখে ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়। কারসাজি চক্র এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবারো পুরনো খেলায় মেতে উঠেছে, প্রথম ফ্লোর প্রাইসের অপকর্মের জরিমানার খবর পাওয়ার সাথে সাথে নতুন করে দ্বিতীয় ফ্লোরপ্রাইসের সময়েও তদন্তের নির্দেশনা এসে গেছে।

৩১ জুলাই ২০২২ তারিখ থেকে ১৩ অক্টোবর ২০২২, এই ৪৯ কর্মদিবসে পুঁজিবাজার বিশ্লেষণ করলে ফ্লোরপ্রাইস সাধারণ বিনিয়োগকারীদের খুব একটা সহায়তা করেছে তেমন মনে করার কোনো তথ্য উপাত্ত চোখে পড়ছে না। বরং লেনদেন হওয়া শেয়ারের মধ্যে, মাত্র ৩% শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পেতে দেখা গিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে শেয়ারের নাম উল্লেখ না করলেও, যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আছেন তারা অবশ্যই বুঝতে পারবেন।

শেয়ারের

নাম

খাত ফ্লোর

প্রাইস

৩১.০৭.২২

১৩/১০/২২

 

দর বৃদ্ধি

%

শেয়ার

প্রতি আয়

৯ মাস

শেয়ার প্রতি

নিট সম্পদ মূল্য

পরিশোধিত

মূলধন

কোটি টাকা

ঔষধ ও রসায়ন ১০৭.৩০ ৯৫১.৩০ ৭৮৬.৫৮% ১.৪৩ ১৩.৫৫ ২০.৩৬
বি ভ্রমণ ও পর্যটন ৪৪.১০ ১৪৬.৯০ ২৩৩% ১.০৭ ১১.৫৪ ১২০.৭৫
সি কাগজ ও মুদ্রণ ১৪৫.৩০ ৩৬০.৮০ ১৪৮.৩১% ২.৭২ ৪২.১৬                ৯.৩৮৯

ওষুধ ও রসায়ন খাতের বি শেয়ারটি মাত্র ৪৯ দিনে ৭৮৬.৫৮% দাম বেড়েছে, কোনো অবস্থাতেই এটা স্বাভাবিক লেনদেন হতে পারে না, অবশেষে নানা সমালোচনার মুখে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক তদন্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়, আমার প্রশ্ন হল, এত দেরি কেন? এর আগেই কেন করা হয় নি? আরও আগে ব্যবস্থা নেওয়া হলে, এভাবে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পেত না। আগস্ট  মাসে এই শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ছিল ২১.৪১% আর বিদেশি বিনিয়োগ ০.২৭% আর সাধারণ জনগণ ছিল ৩৭.৭১% । কিন্তু ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখের পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমে ৭.৫%  আর বিদেশি বিনিয়োগ কমে ০.০৪% আর সাধারণ জনগণ বেড়ে  ৫১.৮৫%। যার অর্থ দাঁড়ায় এই এক মাসে প্রাতিষ্ঠানিক আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুনাফা তুলে নিয়েছে আর সব সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিনে নিয়েছে দাম আরও বাড়বে এই গুজবে। এই খাতের মৌল ভিত্তির অনেক ভাল শেয়ার থাকলেও, অপেক্ষাকৃত দুর্বল মৌল ভিত্তির শেয়ার হওয়া সত্ত্বেও অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়েই চলেছে।

ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের বি শেয়ারটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল মৌল ভিত্তির শেয়ার। এই শেয়ারের ডিভিডেন্ড ঘোষণা এবং প্রথম প্রান্তিক প্রকাশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তৃতীয় প্রান্তিকে মাত্র ০.৩৫ টাকা ইপিএস এবং ৯ মাসে ১.০৭ টাকা ইপিএস, বার্ষিক ইপিএস ১.৩৪ অর্থাৎ শেষ তিন মাসে ইপিএস ০.২৭ টাকা, যা তৃতীয় প্রান্তিকের চেয়ে কম। কিন্তু এবারের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই- সেপ্টেম্বর ২০২২) শেয়ার প্রতি আয় ১.৩৬ যা, শুধু গত দুই প্রান্তিকের তুলানায় অস্বাভাবিক না বরং বিগত এক বছরের চেয়ে এক প্রান্তিকের মুনাফা অধিক। ভ্রমণ ও পর্যটন খাতে এমন ঘটনা ঘটেনি তিন মাসেই গত এক বছরের চেয়ে বেশি মুনাফা হবে। মুনাফার প্রবিদ্ধির প্রভাব গত ৬ মাসেও থাকার কথা। আর বাজারে দাম ধরে রাখতে এত দ্রুত সময়ে প্রথম প্রান্তিক দিয়ে দেয়াও দর বাড়ানোর কৌশল মনে হচ্ছে। এখানে কোম্পানির অবস্থা এত ভাল হলে, উদ্যোক্তা এবং পরিচালকরা মুনাফা না নিয়ে, শুধু সাধারণ শেয়ার মালিকদের কেন দিবে? কারণ এই বছরই কোম্পানি সর্বচ্চ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে। তাই এখানে কোনো কারসাজি আছে কি-না খতিয়ে দেখতে হবে। অস্বাভাবিক ইপিএস প্রবৃদ্ধি শেয়ার দর বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনার অংশ কি-না দেখতে হবে কারণ ৪৯ দিনে শেয়ারটির মূল্য ১২৭.৮% বেড়েছে। প্রথম প্রান্তিক প্রকাশের পর শেয়ার মার্জিনযোগ্য হয়েছে। তাই এখানে ইন-সাইড লেনদেনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কোন পক্ষ না জানলে, তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত যে শেয়ার প্রতি আয় ছিল, সেই আয় দিয়ে কোন ভাবেই এই দাম যুক্তি সঙ্গত দাম হয় না।

সি শেয়ারটি কাগজ ও মুদ্রণ খাতের একটি স্বল্প মুলধনী শেয়ার, টানা ৭ কর্ম দিবস দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায় লেনদেন হচ্ছে এবং বর্তমানে ফ্লোর থেকে ১৪৮.৩১% দর বৃদ্ধি পেয়েছ, যা স্বাভাবিক নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু এজেন্ট নানা গুজব দিয়ে আরও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করছে।

সার্বিক আলোচনায় যা যা সমস্যা দেখা যাচ্ছে তা হল, অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি চক্রের বিরুদ্ধে বিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ, দর কারসাজির উদ্দেশে ইচ্ছাকৃত মুনাফা বাড়িয়ে দেখান, ডিএসই ওয়েবসাইটে সব কোম্পানির তথ্য হাল নাগাদ না থাকা। এসব কারণে বিনিয়োগ শিক্ষা আছে এমন বিনিয়োগকারীরাও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে বিনিয়োগকারীদের নিজস্ব ঝুঁকি নেয়ার সক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ একটা সুশাসনের বাজার উপহার দেয়া, যেখানে অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সাধারণ বিনিয়োগকারিদের হাত পুড়ে যাওয়ার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা কারসাজির সাথে জড়িত তাদের যা জরিমানা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি জরিমানা করা এবং অন্যান্য শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়া। বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, যাতে করে তারা কারসাজি চক্রের হাত থেকে নিজেদের বিনিয়োগকে নিরাপদ রাখতে পারে।

কারসাজি চক্রকে যে পরিমাণ জরিমানা করা হয়, তাতে তাদের তেমন কিছু যায় আসে না, কিন্তু অনেক দিন ধরে গড়ে তোলা আস্থা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। আমাদের দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে তাই পুঁজিবাজারের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি বাড়ছে। সময়ের কাজ সময় মত না করলে কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যায় না। কারসাজি চক্রকে সময় মত ধরতে পারলে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি ভীতি কেটে যাবে। বিনিয়োগকারীরা যখন আস্থা খুঁজে পাবে, বাজার তখনই গতিশীল হবে, এবং অর্থনীতি বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

# আল-আমিন, সহযোগী অধ্যাপক, একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.