আমদানিতে কড়াকড়ি: এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই কমছে

আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে অস্বাভাবিক হারে কমছে আমদানি ব্যয়। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। একই সময়ে ঋণপত্র নিস্পত্তির হার কমেছে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।

এর আগে, এক মাসের ব্যবধানে জুলাই মাসে আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৩১ শতাংশ। একইসময়ে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির হার কমেছে ৯ শতাংশ।

ডলার সংকট নিরসনে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় কমাতে সম্প্রতি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই ফলে কমছে আমদানি ব্যয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস থেকে জুলাই মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ। এসময় আমদানির বিপরীতে ৫৫৫ কোটি ডলারের সমপরিমাণ এলসি খোলা হয়েছে, যা জুন মাসে ছিল ৭৯৬ কোটি ডলার। একই সময়ে ৬৫৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা জুনে ছিল ৭৭৫ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তিতে মিশ্র অবস্থা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর নিষ্পত্তি কমেছে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর পরের মাস মার্চে এলসি খোলা এবং নিষ্পত্তি উভয়ই বেড়েছে। এসময় এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর নিষ্পত্তির হার বেড়েছে ১২ দশমিক ০২ শতাংশ। এরপরের মাস এপ্রিলে এলসি খোলার হার ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ কমলেও নিষ্পত্তি বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

আবার মে মাসে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই কমেছে। এসময় এলসি খোলার হার কমেছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আর নিষ্পত্তির হার কমেছে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। জুন মাসে আবার বেড়ে যায় আমদানি ব্যয়। এসময় এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই বেড়ে যায়। এসময় এলসি খোলার হার বেড়েছে ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আর নিষ্পত্তির হার বেড়েছে ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এরপরের মাস জুলাইয়ে রেকর্ড পরিমাণে কমেছে আমদানি ব্যয়। এসময় এলসি খোলার হার কমেছে ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ ও নিষ্পত্তির হার কমেছে ৯ শতাংশ।

এদিকে, অস্বাভাবিক হারে আমদানি ব্যয় বাড়ায় বিগত চার মাস ধরে ডলারের সংকট চলছে। কারণ, আমদানি যে হারে বাড়ছে, রপ্তানি সে হারে বাড়ছে না। আবার প্রবাসী আয়ও কমেছে। এর ফলে অব্যাহতভাবে বাড়ছে ডলারের দাম। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে টাকার মান কেবলই কমছে। এক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ।

সংকট সামলাতে বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরমধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সীমিত করেছে সরকার। আর আমদানি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৭টি পণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি ডলারের ওপর চাপ কমাতে ব্যাংকগুলোর গাড়ি কেনা বন্ধ করা হয়েছে।

এছাড়া, ডলার সংকট মোকাবিলায় ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ব্যাংকগুলোকে এখন থেকে এলসি খোলার ২৪ ঘন্টা আগে বিস্তারিত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে। এসব সিদ্ধান্তের প্রভাবেই আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। আমদানি ব্যয় কমার এই ধারা অব্যাহত থাকলে খুব শিগগিরই ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরার পাশাপাশি দেশের রিজার্ভ বাড়বে বলেও জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমদানি পরিশোধ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিক উদ্যোগের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। যা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এর ফলে শিগগিরই ডলারের সংকট কেটে দেশের রিজার্ভও বাড়বে।

এদিকে, আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার বা ব্যাংক রেটের চেয়ে অনেক বেশি দামে ডলার কেনাবেচা নিয়ে অন্থিরতা চলছে মুদ্রাবাজারে। বর্তমানে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক ডলারের জন্য খরচ করতে হয়েছে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। তবে সব ব্যাংকেই নগদ ডলারের দাম বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১০৫-১০৮ টাকায় বিক্রি করছে। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে গত সপ্তাহে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১২ টাকায় বেচাকেনা হয় ডলার।

আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়িয়েছে। এরপরও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডলারের দাম।

বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত বছরের আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।

সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রোববারও ৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৪ কোটি (১.১৪ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর আর ওপরে উঠছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই একই জায়গায় ‘স্থির’ছিল ডলার। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর।

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত ১২ জুলাই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকেই রিজার্ভ নিয়ে সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত মে মাসে আকুর বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

অর্থসূচক/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.