বাস্তবে রূপ নিল বাংলাদেশ ব্যাংকের আশঙ্কা

বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে

অস্বাভাবিক হারে আমদানি ব্যয় বাড়লেও সেই তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়ছে না। এছাড়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরণের পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।

সদ্য বিদায়ী (২০২১-২২) অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংক আগেই আশঙ্কা করেছিল। চলতি অর্থবছরেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে নতুন (২০২২-২৩) অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাণিজ্য ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছর (জুলাই-জুন) শেষে বাণিজ্য ঘাটতি তিন হাজার ৩২৫ কোটি ডলারে (তিন লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি) দাঁড়িয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সময় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতিও সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি। বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে দেশ।

সোমবার (০১ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এই প্রসঙ্গে মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, দেশে রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ৩৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি হতে পারে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত পণ্য বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ তিন হাজার ৩২৪ কোটি ৯০ লাখ (৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার বা বর্তমান বিনিময় হার প্রতি ডলার ৯৪ দশমিক ৭০টাকা হিসাবে দেশিয় মুদ্রায় এর পরিমাণ তিন লাখ ১৪ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকার বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আলোচিত সময়ে রপ্তানি থেকে দেশ আয় করেছে চার হাজার ৯২৫ কোটি ডলার। এ সময়ে পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় থেকে রপ্তানি আয় বাদ দিলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার।

মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে আসবে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বাড়বে ৩৫ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমবে ১৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ক্যারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।

নতুন অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমে ১৩ শতাংশে নেমে আসবে। আমদানি ব্যয় বাড়বে ১২ শতাংশ। রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং ১৫ শতাংশ বাড়বে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। আমদানিতে জোয়ারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি।

বেড়েছে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি

এ সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। গেল অর্থবছরে পুরো সময়ে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৯৯৮ কোটি ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৩৮৫ কোটি ডলার। সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৮৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৩০২ কোটি ডলার।

চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ঘাটতি

চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ ঘাটতির (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৬৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতি ছিল মাত্র ৪৫৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার

সামগ্রিক লেনদেনে (ওভারঅল ব্যালেন্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩৮ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে ৯২৭ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

রেমিট্যান্স কমেছে

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত দেশে দুই হাজার ১০৩ কোটি ২০ লাখ ডলার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে একই সময় এসেছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এফডিআই বেড়েছে ৩৯ শতাংশ

দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ে ৩৩৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। গেল অর্থবছরে তা বেড়ে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ ডলারে উঠেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও আগের বছরের চেয়ে ৬০ দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়ে ২১৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৩৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে বড় অঙ্কের ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমদানির লাগাম টেনে ধরা। যে করেই হোক এটা করতে হবে। তা না হলে সংকটে পড়বে পুরো অর্থনীতি।

এই প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, লাগামহীন আমদানিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। ব্যালান্স অফ পেমেন্ট ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার। এখন যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এছাড়া আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই।

আমদানি বাড়ায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন (৪ হাজার কোটি) ডলারের নিচে নেমে এসেছে। সোমবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে ৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.