নিয়ন্ত্রণহীন ডলারের বাজার: ব্যাংক-খোলা বাজারে একই রেট

আবারও এবিবি-বাফেদার সাথে বৈঠক করবে বাংলাদেশ ব্যাংক

কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডলারের বাজার। খোলা বাজারের পর এবার ব্যাংকগুলোও এক দিনের ব্যবধানে প্রতি ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে আমদানিকারকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা আদায় করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আবারো অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। শিগগিরই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।

বুধবার (২৭ জুলাই) খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম খানিকটা কমেছে। তবে এক দিনের ব্যবধানে ব্যাংকগুলো ৭ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে নগদ ডলার। এতে কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকে ডলারের দাম প্রায় সমান হয়ে গেছে।

বেসরকারি ইষ্টার্ন ব্যাংক এক দিনের ব্যবধানে ৭ টাকা বাড়িয়ে বুধবার প্রতি ডলার ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছে। মঙ্গলবার এই ব্যাংকে ডলারের দাম ছিল ১০১ টাকা।

আইএফআইসি ও সিটি ব্যাংক থেকে এক ডলার কিনতে বুধবার গুনতে হয়েছে ১০৭ টাকা। এদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক ১০৩ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। অন্য তিন সরকারি ব্যাংক সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০২ টাকায়।

যদিও বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া আন্তব্যাংক দর (ব্যাংক রেট) ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। এই দামে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকগুলো এই দরের চেয়ে ৮ থেকে ১৩ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে।

এদিকে, খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দামে অবশ্য বেশ খানিকটা কমেছে। বুধবার বেলা দেড়টার দিকে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১০৮ টাকায়। এক দিনের ব্যবধানে গতকাল মঙ্গলবার দাম ৭ টাকা বেড়ে ১১২ টাকায় উঠে গিয়েছিল।

সাধারণত ব্যাংক রেটের ব্যাংকগুলোতে ডলারের দর দেড় থেকে দুই টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ব্যাংক রেটের চেয়ে ৬/৭ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ১৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে।

এই প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে ডলারের চরম সংকট চলছে। পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার প্রয়োজনীয় ডলার নেই ব্যাংকগুলোর কাছে।

বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেও চাহিদা মিটছে না। সে কারণে বেশি দামে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে। বাধ্য হয়ে তাকে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

তারা বলেন, ইন্টারব্যাংক রেট একরকম অচল হয়ে গেছে। এই রেটে কেবলমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে অল্প কিছু ডলার বিক্রি করে। সেটা দিয়ে ব্যাংকগুলোর কিছুই হয় না। সব ব্যাংক পায় না। যেসব ব্যাংক জ্বালানি তেলসহ সরকারের অন্য পণ্য আমদানির এলসি খোলে, তারাই ইন্টারব্যাংক রেটে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার পায়।

এছাড়া দাম আরও বাড়বে-এমন গুজবে অনেক মানুষ পুঁজিবাজারে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে ডলার কিনে মজুদ বাড়িয়ে রাখছেন।

অনেকে আবার তিন-চার মাস পর দেশের বাইরে যাবেন, তাই প্রয়োজনীয় ডলার এখনই কিনে রাখছেন। সব মিলিয়ে মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা করছেন তারা।

এই প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যত দ্রুত সম্ভব ডলারকে মাটিতে নামিয়ে আনতে হবে। টাকাকে শক্তিশালী করতে হবে।

তিনি বলেন, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করা ব্যাংক ঋণের সুদের হারের সীমা তুলে দিতে হবে। যে কাজটি রাশিয়া করেছিল এবং সফল হয়েছে। এই মূহুর্তে আমাদেরও ঠিক এই কাজটিই করতে হবে।

বর্তমানে আমাদের সুদের হার ৯ শতাংশ। সেটা স্বল্প সময়ের জন্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করা হলে বাজারে টাকার সরবরাহ কমে আসবে। পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে কেউ আর ডলার কিনতে যাবে না। তখন এমনিতেই ডলারের দাম কমে আসবে।

একই সঙ্গে আমদানির লাগাম টানতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে।

এক দিনের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম এতো বেশি বাড়ার কারণ জানতে চাইলে এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন অর্থসূচককে বলেন, বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো বর্তমানে আমাদের ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে বেশি দামে এমনকি ১০৬ বা ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। বেশি দামে ডলার সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে ডলারের আন্তব্যাংক রেটটা অচল হয়ে গেছে। এটাকে সচল করতে হবে। এজন্য কিছু অপারেশনাল পদক্ষেপ নিতে হবে।

কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবারও এবিবি এবং বাফেদার সাথে এই বিষয়টি নিয়ে বসবেন। সেখানেই কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেগুলো আলোচনা করা

হবে। যে করেই হোক আন্তব্যাংক রেটটাকে সচল করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে।

এছাড়া, ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সরকার থেকেও বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে এই সংকট কেটে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এদিকে, বাজার স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। আজ বুধবারও ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, ডলার সংকটের কারণে এই মুহূর্তে আমরা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এখন পর্যন্ত মার্কেট স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ৭ বিলিয়ন ডলার সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। দেড় বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স বিদেশে আটকে আছে। যেটা এখনো আনা হয়নি।

এছাড়া ব্যাংকগুলোর নষ্ট্রো অ্যাকাউন্টে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বিল আটকে আছে। আটকে থাকা এসব ডলার দ্রুত ফেরত আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।

তিনি আরো বলেন, এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলো যদি এসব ডলার বিদেশ থেকে না নিয়ে আসে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক আর ডলার সাপোর্ট দেবে না। ব্যাংকগুলোর সাপোর্টের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২৭ দিনে (১ থেকে ২৭ জুলাই) প্রায় ১১০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। তারপরও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা ততই বাড়ছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.