সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ঠিক রাখার চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক ও অন্যান্য কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে একদিকে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমানো হয়েছে। নীতিহার হিসেবে বিবেচিত রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে বর্তমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫.৫০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে।

আর বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি দশমিক শূন্য সাত শতাংশ কমিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, তবে বাড়ানো হয়েছে সরকারকে ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা। অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত সরকারের লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ যোগানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৯. ৪ শতাংশ, যা গতবার ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.২ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ র্নিধারণ করা হয়েছিল। এর মানে হল, নতুন অর্থবছরে সরকারি খাতের ওপর ভর করে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে গভর্নর বলেন, মুদ্রানীতির লক্ষ্য অর্জনে প্রণীত অর্থ ও ঋণ কর্মসূচীর সঠিক বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য যেসব নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমনের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতসমূহে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে নীতিহার হিসেবে বিবেচিত রেখো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে বিদ্যমান ৫.০০ শতাংশ হতে ৫.৫০ শতাংশে নির্ধারণ করা; আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে আমদানি বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন পুনঃঅর্থায়ন স্কীম চালু করা; এবং বিলাস জাতীয় দ্রব্য, বিদেশী ফল, অপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন- অ-শস্য খাদ্যপণ্য, টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে এগুলোর এলসি মার্জিন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ঋণের সুদহার তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেয়া হলেও এই বিষয়ে মুদ্রানীতিতে কোন উদ্যোগ নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট জানালো, ঋণের একক ৯ শতাংশ এই সুদ হারেও কোন চাপ নেই।

জানা গেছে, সরকার বাজেটে যে নীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচি ঠিক করে, তা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখাই মুদ্রানীতির লক্ষ্য। এমনভাবে এই নীতি সাজানো হয় যাতে অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র বিমোচনে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়। বাজেট বাস্তবায়নে বছরের পুরো সময়টায় বাজারে অর্থপ্রবাহ ও আঙ্গিক কেমন হবে, তাও মুদ্রানীতিতে ঠিক করে দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে ধরা হয়েছে ১২.১ শতাংশ, গতবার এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ শতাংশ; চলতি জুন পর্যন্ত এর ৯.১ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটের সাথে মিল রেখে মুদ্রানীতিতেও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংক। এটাই ছিল গভর্নর ফজলে কবিরের শেষ মুদ্রানীতি ঘোষণা। আগামী ৩ জুলাই গভর্নর হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নিচ্ছেন তিনি। এক সময় ছয় মাস পরপর মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও গভর্নর ফজলে কবির ১ বছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রচলন করেন। এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে কোন রকম চাপের কাছে নতি স্বীকার করে দেশের ক্ষতি হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয় নাই, এটাই বড় তৃপ্তি।

মুদ্রানীতি প্রকাশের দিনেই সংসদে পাস হয়েছে আগামী অর্থবছরের বাজেট। ঘটনাটিকে রাজস্বনীতি এবং মুদ্রানীতির সমন্বিত সহাবস্থান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ কঠিন চ্যাল্ঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে অর্থনীতিকে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সাথে কোন কম্প্রোমাইজ নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অর্থসূচক/এএইচআর

 

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.