‘অর্থনীতির অসুখ চিহ্নিত হয়েছে, ওষুধ ঠিক হয়নি’

বাজেটে পর্যালোচনায় সিপিডির অভিমত

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের অর্থনীতিতে বিরাজমান অসুখের নানা লক্ষণ চিহ্নিত করতে পেরেছেন। কিন্তু সেই অসুখ সারানোর জন্য সঠিক ওষুধ দিতে পারেননি তিনি। যে ওষুধ তিনি দিয়েছেন, তা অপর্যাপ্ত। কোনোটিতে ডোজ ঠিক হয়নি। হয়তো রোগের ওষুধ তার কাছে নেই।

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করতে গিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এ কথা বলেছে।

বৃহস্পতিবার (৯ জুন) অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার দেওয়া বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ৬টি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন। সিপিডির মতে এই চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে অর্থনীতিতে বিরাজমান অসুখের লক্ষণ।

এগুলো হলো – মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্য বৃদ্ধির ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান করা; বৈদেশিক অর্থের ব্যবহার এবং প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা; শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা; অভ্যন্তরীণ মল্যূ সংযোজন কর আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও ব্যক্তি আয়করদাতা বৃদ্ধি করা; টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা ও রির্জাভ সন্তোষজনক রাখা।
এই লক্ষণগুলোতে যে ঔষধ দেয়া দরকার ছিল বা যে মাত্রায় দেয়া দরকার ছিল,সেটা দেওয়া হয়নি।

এই প্রসঙ্গে সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থমন্ত্রী অসুখের লক্ষণ ধরতে পেরেছেন কিন্তু ঔষধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে ঔষধ দরকার হয় তার কাছে সেটা পর্যাপ্ত নেই অথবা ঔষধ জানা নেই অথবা যে মাত্রায় ঔষধের ডোজ দেওয়া দরকার, সেই মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করা হয় নি।
তিনি বলেন, যে চ্যালেঞ্জগুলোর কথা অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য যে উদ্যোগ নেয়া দরকার, সেই উদ্যোগগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে অপর্যাপ্ত বা অপ্রতুল মনে হয়েছে। অর্থাৎ ঘোষণার সঙ্গে কার্যকর উদ্যোগের কোন মিল নেই।

 

তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে মূল্যস্ফীতিজনিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, মূল্যস্ফীতি বাইরে থেকে আগত, সুতরাং অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এটিকে যতোটা ব্যবস্থাপনা করা যাবে সেটি করতে হবে। এছাড়া এই মূল্যস্ফীতিজনিত অভিঘাতগুলো যে শ্রেণীপেশার মানুষের উপরে পড়ছে, তাদের জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

 

এক্ষেত্রে, সিপিডির পক্ষ থেকে যে কয়েকটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে যে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো। এতে দরিদ্র নয় কিন্তু স্বল্প আয়ের মানষদের কিছুটা আয়ের সংস্থান দেওয়া যেতো। এতে বর্তমান মূল্যস্ফীতিজনিত পরিস্থিতিতে তারা অন্তত কিছুটা প্রকৃথ আয় বেশি পেয়ে ভালোভাবে ঠিকে থাকতে পারতেন। দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির কথা বলা হলেও সেখানে তেমন কোন কার্যকর কর্মসূচী নেওয়া হয় নি। অর্থৎ সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বললেও দুর্ভাগ্যবশতসেখানে বরাদ্দ বাড়ানো তো হয়ই নি অনেক ক্ষেত্রেই সেটা কমানোর ঘোষণা রয়েছে। যেটা এই বাস্তবতায় মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এতেইবোঝা যাচ্ছে ওষুধের ডোজের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা রয়েছে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওষুধের ডোজই আসলে দেওয়া হয় নি।

বাজেটে ভর্তুকির ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে। এই জায়গায় ওষুধের ডোজ ঠিক হলেও সেখানে তিনি বলছেন যে, ভর্তুকি সমন্বয় করার পরেও পুরো সময় তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মূল্য সমন্বয় না করে তিনি থাকতে পারবেন না। তার মানে হচ্ছে ভোক্তা পর্যায়ে আগামী দিনে বিদ্যুৎ এবং তেলের দাম বাড়ানোর একটা ঘোষণা আসতে পারে। আমরা জোরালোভাবে বলতে চাই, এখন যে পরিস্থিতি তাতে জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তার প্রকৃত আয় আরো কমিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময় এটি নয়। আমরা মনে করি এখনইসেটা না করে বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম উঠানামার বিষয়টি বিবেচনা করে যেন অন্ততপক্ষে ৬ মাস পরে সেটি সমন্বয় করা হয়।

 

বলা হয়েছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এই দুই খাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে কমানো হয়েছে।
বাজেটে বলা হয়েছে যে, ডলারের বাজারে নিয়ন্ত্রণ আনা হবে। কিন্তু সেটা করার জন্য একটি ভুল ঔষধের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমরা কোনভাবেই মনে করি না যে, টাকা বেনামে বাইরে চলে যাবে, সেটা করের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেবেন। এটা দেশে যারা সৎ করদাতা রয়েছেন কিংবা যারা কর ব্যবস্থায় আস্থা রাখছেন তাদের উপর চপেটাঘাত। আমরা মনে করি অর্থমন্ত্রীর এই জায়গা থেকে সরে আসা উচিত। কেননা এতে যাকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে সে সহ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত থাকবে তারাও সবসময় একই সুযোগ খুঁজে বেড়াবে। এছাড়া এর আগেও এই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে খুব বেশি টাকা আসে নি। তারপরেও কেন এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেই বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এই বিষয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ নীতি-নৈতিকতার সাথে খাপ খায় না। তিন কারণে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব সমর্থন করা যায় না। এটা নৈতিকতা, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক- সব দিক থেকেই এটা অগ্রহণযোগ্য।
ওই প্রস্তাব নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য না হওয়ার কারণ বৈধভাবে বিদেশে টাকা পাঠানোর (পাচার) করার কোনো সুযোগ নেই। যারা বিদেশে টাকা পাঠিয়েছেন তারা দুর্নীতি, রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন না করা, ওভার ইনভয়েসিং, হুন্ডি-হাওলা ইত্যাদির মাধ্যমে অবৈধভাবে তা পাঠিয়েছেন। দেশের একাধিক আইনে অর্থ পাচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাজেটে পাচারকারীদের শাস্তি না দিয়ে প্রণোদনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে এটি লাভজনক নয়। কারণ এই ধরনের সুবিধার কারণে যারা আগে বিদেশে টাকা পাচার করেনি, তারাও পাচারে উৎসাহী হয়ে উঠতে পারে। এর আগে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হয়েছিল সেটাতে খুব বেশি রাজস্ব বাড়েনি। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবেও এটা কার্যকর নয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক দিকথেকে বিবেচনা করলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় প্রকৃত বরাদ্দ কমানোর বিপরীতে পাচারকারীদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি দেশের মানুষ ভালভাবে নেবে না।

ড. মুস্তফিজ মনে করেন, এই প্রক্রিয়ায় দেশে কোনো অর্থ আসবে না। কারণ যারা দেশের বাইরে টাকা পাচার করে তারা দেশে ফিরে আসার জন্য টাকা পাচার করে না।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.