ব্যাংকঋণ বাড়লেও কমেছে সঞ্চয়পত্রে

চলতি অর্থবছরের শেষদিকে এসে বাজেট ঘাটতির অর্থ জোগাতে ব্যাংক ঋণে ঝুঁকছে সরকার। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়ছে। অন্যদিকে, সরকারের কৌশল অনুযায়ী সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকগুলোর কাছে এখন পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিলেও বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে না। তবে, বর্তমানে আমদানি যে হারে বাড়ছে
সেই অনুযায়ী বিনিয়োগ বাড়লে তখন সমস্যা দেখা দিবে। কেননা সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তারা।

তাদের মতে, তবে এবার বোধ হয় সমস্যা একটু কম হবে। কেননা, সরকারের ব্যয় সংকোচনের ধারাবাহিকতায় অতি প্রয়োজন ছাড়া অন্য প্রকল্পগুলোর কাজ আমরা আপতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে আমদানিনির্ভর প্রকল্পগুলোর কাজ একেবারেই বন্ধ রাখা হচ্ছে। তাই ব্যয়টা একটু কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (১ জুলাই থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত) ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকার মোট ৩২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এরমধ্যে বাণিজ্যক ব্যাংকগুলো থেকে নিয়েছে ২৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৭ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে নিয়েছিল মাত্র ৬ হাজার ৪০২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে এই দশ মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি।

এই প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান মনসুর অর্থসূচককে বলেন, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিলে সরকারকে অনেক বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়। তাই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে শর্ত আরোপ করা সঠিক হয়েছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো সমস্যা হবে না।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু ব্যাংকগুলোতে এখন পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে, ফলে ব্যাংকঋণ বাড়লেও এখনই কোন সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, সরকার মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে চাচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাড়তি টাকার প্রয়োজন হচ্ছে। এ জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে। তবে এ ঋণের চাপে যেন বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার কথাও জানান তিনি।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয় সরকার।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে অনুদান ছাড়া ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল ব্যাংক খাত। এবারও ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর আগের অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও এর বিপরীতে সরকার নিয়েছিল মাত্র ২৬ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।

সরকারের ঋণ নেওয়ার সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ২৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৭ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এই হিসাবে ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে আলোচ্য সময়ে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা।

এদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এরমধ্যে নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে নিয়েছে ১৬ হাজার ৫০৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কমানোর কৌশলে সফল হয়েছে সরকার। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এই খাত থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। এই অংক ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। গত অর্থবছরে এই নয় মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৩ হাজার ২০২ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছিল সরকার।

২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। মূল বাজেটে এ খাত থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজটে সেই লক্ষ্য বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়।

তবে বছর শেষে দেখা যায়, সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে মূল বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ নিয়েছে। সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বেশি নিয়েছে ৩২ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি নিয়েছে প্রায় তিন গুণ।

ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি। সে কারণে বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে সরকার। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি।

সবশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তারপর থেকেই বিক্রিতে ভাটা পড়ে।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.