পুঁজিবাজারে পিকের যত লুটপাট

দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম শীর্ষ জালিয়াত ও লুটেরা প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) ভারতের কলকাতায় গ্রেফতার হয়েছেন। দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করেছে।

বহুল আলোচিত পিকে হালদার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়, তারা প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনেই কয়েক বছর ধরে এই লুটতরাজ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পিকে ও তার দোসরদের অর্থ লুটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন একজন ডেপুটি গভর্নর ও একজন নির্বাহী পরিচালকসহ কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা পিকে হালদারকে সুরক্ষা দিয়েছেন, তার লুটতরাজের সুবিধাভোগী হয়েছেন।

পিকে হালদারের লুটতরাজের অন্যতম বড় শিকার দেশের পুঁজিবাজার। এই বাজারে তালিকাভুক্ত কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লুট করে সেগুলোকে অন্ত:সারশূন্য করে দিয়েছেন। কোম্পানিগুলো হচ্ছে-পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। তীব্র আর্থিক সংকটের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ পিপলস লিজিং অবসায়নের পথে আছে। এই প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম বন্ধ। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো চালু আছে বটে। তবে উপরে এদের খোলসটা-ই আছে। ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁপা। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণ প্রায় বন্ধ। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান-কেউ এদের কাছে আমানত রাখতে রাজি নয়। অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে যারা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত রেখেছেন, তাদের আমনত ফেরত পাচ্ছেন না।

পিপলস লিজিংয়ের অবসানের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১৩ মে থেকে স্টক এক্সচেঞ্জে এর শেয়ার লেনদেন বন্ধ আছে। ফলে আমানতকারীদের মতো কোম্পানিটির সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররাও বিপদে পড়েছেন। তারা অতি জরুরী প্রয়োজনেও তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করতে পারছেন না।

অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স এবং বিআইএফসির লেনদেন চালু থাকলেও শেয়ারের দাম কমতে কমতে তলানীতে এসে ঠেকেছে। গত বৃহস্পতিবার (১২ মে) সর্বশেষ লেনদেন দিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের এফএএস ফাইন্যান্সের শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে ৫ টাকা ১০ পয়সা দরে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ার ৫ টাকা ৮০ পয়সা এবং বিআইএফসির শেয়ার ৬ টাকা ৮০ পয়সা দরে লেনদেন হয়েছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রকৃত মালিকও পিকে হালদার। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক অনুসন্ধানে বিষয়টি উঠে এসেছে। ২০১৫ সালে কোম্পানিটি অভিহিত মূল্যের সাথে ১০ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে ২০ টাকা দরে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজারে আসে। বাজার থেকে উত্তোলন করে ৬০ কোটি টাকা। আইপিওতে আসার আগে ৩ টাকা ৩৩ পয়সা ইপিএস (শেয়ার প্রতি আয়) দেখানো কোম্পানিটির ইপিএস এখন ১ টাকারও কম। বাজারে শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে অভিহিত মূল্যের নিচে।

সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ আইপিও আসার সময় তার আর্থিক অবস্থা কোনোভাবেই প্রিমিয়াম পাওয়ার মতো শক্তিশালী ছিল না। হিসাবকারসাজির মাধ্যমে কোম্পানির মুনাফা ও সম্পদ মূল্য ফুলিয়েফাঁপিয়ে দেখিয়ে কোম্পানিটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বাড়তি ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির তৎকালীন কমিশনের সাথেও এর যোগসাজশ ছিল বলে অভিযোগ।

এছাড়া পুঁজিবাজারে বিভিন্ন শেয়ারের কারসাজিতেও বিভিন্ন সময়ে পিকে হালদারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কোনো তদন্ত না চালানোয় সেসব অভিযোগের প্রকৃত অবস্থা জানা যায়নি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য প্রতিষ্ঠান কেএইচবি সিকিউরিটিজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংক হাল ক্যাপিটাল এর প্রধান অংশীদার পিকে হালদার। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সিকিউরিটিজ ও রিলায়েন্স সিকিউরিটিজসহ বেশ কয়েকটি ব্রোকারহাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির উপর ছিল তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। বিশেষ করে চট্টগ্রামের একটি শিল্পগোষ্ঠির মালিকানায় থাকা পুঁজিবাজারের সব মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান মূলত পিকে হালদারই পরিচালনা করতেন। আর এসব প্রতিষ্ঠানকে তিনি বিভিন্ন কোম্পানি দখল ও শেয়ার কারসাজির কাজে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.