পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসবে: অর্থমন্ত্রী

দেশ থেকে পাচার হয়ে যেসব টাকা দেশের বাইরে গেছে বলে অভিযোগ আছে, তা ফেরত আসবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, বিদেশে টাকা রেখে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি। তাই এমনভাবে সুযোগ-সুবিধা বাড়াবো, যাতে সবাই টাকা দেশে ফেরত নিয়ে আসে।

বৃহস্পতিবার (১২ মে) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনিস্টিটিউটে বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৯-২০২০ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মোহাম্মদ নাছের।

অনুষ্ঠানে ২০১৯ ও ২০২০ এর জন্য ৬৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাঁচটি ক্যাটাগরিতে এসব পুরস্কার দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- সাধারণ পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংক ও রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রবাসীদের মালিকানাধীন এক্সচেঞ্জ হাউজ।

২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেওয়ার রীতি চালু করে। করোনার কারণে গত দু’বছর বন্ধ থাকায় সপ্তমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক এই আয়োজন করেছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশ থেকে যে অর্থ পাচার হচ্ছে তা জানা থাকলে ও উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তবে পাচার হওয়া সব অর্থ দেশে ফিরবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আমেরিকা, ইউরোপের অনেক দেশে এখন টাকা রাখলে কমিশন দিতে হয়। এখন আর সুদ পায় না। তাই যেকোনো উপায়েই হোক বাংলাদেশে টাকা চলে আসবে। কারণ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখলে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়।

অনুষ্ঠানের প্রবাসীরা ওয়েজ আর্নার বন্ডের বিনিয়োগ সীমা বাড়ানোর দাবি জানালে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব। আশা করছি প্রবাসীদের স্বার্থে ইতিবাচক সাড়া পাব। আপনারা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাবেন। আমরা আপনাদের সাপোর্ট দেব, আপনারা দেশকে সাপোর্ট দেবেন।

তিনি বলেন, বিশ্বযুদ্ধের পর এখন সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে। করোনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এই করোনা ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে পঞ্চম, এশিয়ায় প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ। আমরা কাজ করি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য।

প্রবাসীদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, আপনাদের রেমিট্যান্স পাঠানোর অনেক সোর্স আছে। কিন্তু সরকারি মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনো উপায় গ্রহণযোগ্য নয়।  আপনারা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সহায়তা করবেন। রেমিট্যান্সের ওপরে প্রণোদনা দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছি। রেমিট্যান্স আনতে যারা কাজ করছে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি না আমরা সেটাও ভেবে দেখব।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবীর বলেন, সরকারের প্রণোদনা দেওয়ার কারণে রেমিট্যান্স বেড়েছে। প্রবাসীরা সরাসরি আসার কারণেও করোনাকালে রেমিট্যান্স বেড়েছে, ডিজিটাল হুন্ডির কারণে নয়।

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপি পন্যমূল্যের অস্থিরতায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। তাই এখন বৈধপথে প্রবাসী আয় আহরণকে সবোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়নের কাছাকাছি যাবে বলে আশা করছি।

অনুষ্ঠানে বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা কমাতে, ব্যাংকগুলোকে একক দাম বেঁধে দেয়ার দাবি জানান ব্যাংকাররা। অনুষ্ঠানে ব্যাংকাররা বলেন, করোনার বিধি নিষেধ উঠে যাওয়ায় হুন্ডির প্রবণতা বেড়েছে। খোলা বাজারে ডলারের বিপরীতে বাড়তি অর্থ পাওয়ায় অনেকেই বেছে নিচ্ছেন অবৈধ পথ। পরিস্থিতির লাগাম দিতে তাই এক দেশ একক ডলারের রেট বেধে দেয়ার দাবি তাদের।

এসময় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মোহাম্মদ শিরিন বলেন, রেমিট্যান্স ব্যবস্থায় এক্সচেঞ্জ রেট গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডি রেট বেশি দিলে ব্যাংকে টাকা পাঠায় না। তাই আমরা প্রস্তাব করছি, এক দেশ এক রেট হওয়া উচিত। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রেট দিলে আমরা পরিপালন করি, অন্য যারা করছে না তারা রেমিট্যান্স বেশি পায়। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তাই যে কোনো নিয়ম করলে যাতে সবাই পরিপালন করে সেই ব্যবস্থা করা উচিত।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মানতে গিয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমদানি চাহিদা বাড়ছে, রেমিট্যান্স কমেছে। রেমিট্যান্সের সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায় তা ভেবে দেখতে হবে।

করোনার দুই বছরে বিশ্ব যখন টালমাটাল তখনও বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রেখেছে প্রবাসী আয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহামারির মধ্যেও ২০২১ সালে ২ হাজার ২০০ কোটি ২০ লাখ (২২.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কোনো বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

এর আগে এক বছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালে; ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।

তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরোটা সময়জুড়ে (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা গেছে। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

গত অর্থবছরের সাত মাসেই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। তবে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এপ্রিল ছাড়া সব মাসেই ২ বিলিয়ন ডলারের কম রেমিট্যান্স এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এক হাজার ৭৩০ কোটি ৭৭ লাখ (১৭.৩০ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ২ হাজার ৬৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার (২০.৬৬ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবে জুলাই-এপ্রিল সময়ে রেমিট্যান্স কমেছে ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। এই ১০ মাসে গড়ে এক দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই প্রণোদনা বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে।

অর্থসূচক/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.