কমেছে ইপিএস, বেড়েছে শেয়ারের দাম

আবারও লেনদেনে অস্বভাবিক আচরণ দেখা গেল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেডের (বিডি ফাইন্যান্স) শেয়ারে। চলতি হিসাববছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির নিট মুনাফা ও শেয়ার প্রতি আয় (Earning per share-EPS) কমলেও শেয়ারের দামে দেখা গেছে ঠিক বিপরীত চিত্র। এই নেতিবাচক খবরের মধ্যেও প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রথম কার্যদিবসেই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে।

ইপিএস কমে যাওয়ার খবরে শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়ার মতো অস্বাভাবিক ঘটনা দেশের পুঁজিবাজারে নেই কমই ঘটে। তারউপর এমন দিনে শেয়ারটির দাম বেড়েছে, যেদিন বাজারে দরপতনের ঝড় বইয়ে গেছে। স্টক এক্সচেঞ্জে মূল্যসূচক কমেছে এক শতাংশের বেশি।

গতকাল মঙ্গলবার (১০ মে) বিডি ফাইন্যান্সের পরিচালনা পর্ষদ গত ৩১ মার্চ, ২০২২ তারিখে সমাপ্ত প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করে। এই প্রতিবেদন অনুসারে, আলোচিত প্রান্তিকে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) করেছে ৪২ পয়সা, যা আগের বছর ছির ৪৭ পয়সা। আগের বছরের তুলনায় কোম্পানিটির ইপিএস কমেছে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

আজ দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে বিডি ফাইন্যান্সের ইপিএস সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা হয়।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) আজ বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ারের দাম ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেড়েছে। গতকাল ডিএসইতে এই কোম্পানির শেয়ারের ক্লোজিং মূল্য ছিল ৪৩ টাকা ১০ পয়সা। আজ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ টাকা ১০ পয়সা।

আয় কমার খবরে শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়া, বিশেষ করে বাজারে বড় দর পতনের দিনে এমন ঘটনাকে মোটেও স্বাভাবিক মনে করছেন না বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের সন্দেহ, এর পেছনে কারসাজি থেকে থাকতে পারে।

অতীতেও কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে নানা কারসাজির অভিযোগ থাকায় আজকের বিষয়টিকে অনেক বেশী অস্বাভাবিক মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ডিএসই থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২ বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের দামে বড় ধরনের উত্থান-পতন হয়েছে। বিশেষ করে শেয়ারের দামের উত্থানের বিষয়টি অবিশ্বাস্য।

২০২০ সালের শুরুর দিকে স্টক এক্সচেঞ্জে বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ারের দাম ছিল অভিহিত মূল্যের কম। ওই বছরের ৩১ মে ডিএসইতে বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ারের দাম ছিল ৭ টাকা ৯০ পয়সা। এর পর থেকে শেয়ারটির দাম বাড়তে থাকে। দেড় বছরেরও কম সময়ে ২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শেয়ারের মূল্য বেড়ে ৬৯ টাকা ৮০ পয়সায় পৌঁছায়। দেড় বছরে শেয়ারটির মূল্য বাড়ে ৭৮৪ শতাংশ, যা অস্বাভাবিকতারও চূড়ান্ত।

নানা কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারটির মূল্য বাড়ানো হয় বলে অভিযোগ আছে। অভিযোগ অনুসারে, এই কারসাজিতে নেতৃত্ব দিয়েছে খোদ উদ্যোক্তারা। এই কোম্পানির উদ্যোক্তা, একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজের কর্ণধার ছিলেন এর নেপথ্য ভূমিকায়। আর এই কারসাজির অংশ হিসেবে অন্যান্য কৌশলের পাশাপাশি নানা গুজব ছড়ানো ও ভূয়া মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (PSI) প্রকাশের সহায়তা নেওয়া হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভুইঁফোড় কোম্পানির বিনিয়োগ সংক্রান্ত পিএসআইও ছিল।

গত বছরের শুরুর দিকে খবর রটানো হয়, মার্কিন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান সভরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপ বিডি ফাইন্যান্সের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। তাতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম।

গত বছরের ৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে বিডি ফাইন্যান্সের সঙ্গে সভরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বিডি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কায়ছার হামিদ এবং সভরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ল্যারি নক্স নিজ নিজ পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে ১১ এপ্রিল এ চুক্তির বিষয়টি ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, যার মাধ্যমে দেশের বিনিয়োগকারীদের এ বিষয়ে জানতে পারেন।

কথিত চুক্তি অনুসারে, বিডি ফাইন্যান্সের মাধ্যমে সভরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপ বাংলাদেশের অবকাঠামোগত খাতে প্রায় ২০০ কোটি ডলার অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছে। সরকার বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) ঋণ ও ইকুইটি সহায়তা এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে অর্থায়ন করতে চায় এসআইজি। প্রাথমিকভাবে বিডি ফাইন্যান্সে ৪ কোটি ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, পরিবেশবান্ধব প্রকল্প, নারী উদ্যোক্তা, সামাজিক আবাসন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ করা হবে।

একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সভরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গ্রুপ অনেকটা ভুঁইফোড় ধরনের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের মূলধনের পরিমাণ ১ কোটি ডলারেরও কম।

একটি ন্যানো কোম্পানির এত বড় বিনিয়োগের খবর এবং চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাসের মধ্যে কোনো অগ্রগতি না থাকায় চুক্তির পুরো বিষয়টি সাজানো বলে সন্দেহ বাড়তে থাকে। এর প্রেক্ষিতে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুঁজিবাজারে আলোচিত চুক্তি স্বাক্ষরের আর্থিক প্রভাব সম্পর্কিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এখন পর্যন্ত ওই তদন্তের কোনো ফলাফল জানা যায়নি।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.