বাড়ছে ডলারের দাম, মান হারাচ্ছে টাকা

টাকার মান আরো অবমূল্যায়নের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের

অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে শক্তিশালী হচ্ছে ডলার; বিপরীতে দুর্বল হচ্ছে টাকা। অর্থাৎ আবার বেড়েছে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম। মাঝে দেড় মাস ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকলেও আজ রোববার তা আবার বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক ডলারের জন্য ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা খরচ করতে হয়েছিল; সেখানে আজ রোববার লেগেছে ৮৬ টাকা। আর ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে চার-পাঁচ টাকা বেশি দরে। ফলে খোলা বাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯১ টাকা বা তার চেয়েও বেশি দামে।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থির ছিল ডলারের দর। ৫ আগস্ট থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। বাড়তে বাড়তে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায় উঠার পর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে গত বৃষ্পতিবার পর্যন্ত ওই দামে স্থিতিশীল ছিল। অর্থাৎ প্রায় দেড় মাস পর আজ রোববার থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এই হিসাবে গত পাঁচ মাসে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা ১ টাকা ২০ পয়সা বা ১ দশমিক ৪১ শতাংশ দর হারিয়েছে।

ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অবমূল্যায়নে কিছুটা স্বস্তিতে থাকেন দেশের রফতানিকারকরা। তাদের মতে, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে। করোনা মহামারির সময়ে তারা মুদ্রার মান অবমূল্যায়ন করেই চলছে, কিন্তু সেই তুলনায় বাংলাদেশ এখনও সেভাবে অবমূল্যায়ন করেনি। রফতানিকে উৎসাহিত করতে টাকার মান আরও অবমূল্যায়ন করা উচিত বলে তারা মন্তব্য করেন।

তবে, ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন আমদানিকারকরা। একদিকে করোনায় সামুদ্রিক জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং কন্টোইনার সংকটে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। কাঁচামাল ও উৎপাদনে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে বর্ধিত দামে। এর সঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি যোগ হচ্ছে পণ্যের উৎপাদন খরচে। ফলে ভোক্তাসাধারণকে আগের চেয়ে বেশি মূল্যে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।

আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে চাল, ডাল, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, শিশুখাদ্য, মসলা, গম, বিমানের টিকিট ও বিদেশে চিকিৎসা খরচ। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) জাতীয় বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে পাঁচ শতাংশের ঘরে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যদিও ডিসেম্বর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, আমদানি ব্যয় বাড়লেও পর্যাপ্ত রিজার্ভ থাকায় এতে এখনই উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তবে মুদ্রা বিনিময় হারে যে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

এই প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থসূচককে বলেন, ডলারের মূল্য বেড়ে ব্যাংকে এখন ৮৬ টাকা। আর খোলাবাজারে তা ৯১ টাকা বা তার চেয়েও বেশি। এক্ষেত্রে পার্থক্য অনেক বেশি। এতে ব্যাংক ব্যবস্থায় অর্থের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হতে পারে।

এই অবস্থায় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান ৩ থেকে ৪ শতাংশ অবমূল্যায়ন করতে হবে। এতে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

তিনি আরো বলেন, মূল্যস্ফীতি কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। অবশ্য বিশ্বজুড়েই এখন মূল্যস্ফীতি বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও চালের দাম চড়া। এর প্রভাব বাংলাদেশেও কিছুদিন থাকবে। অন্যদিকে আমদানি অনেক বাড়ছে। সেই তুলনায় রফতানি আয় এবং রেমিট্যান্স বাড়ছে না। ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছে।

ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে চাল আমদানি বাড়াতে হবে। গত বছরও ৮ লাখ টন চাল আমদানি করেছিল সরকার। চলতি বছর তা বাড়িয়ে ১৫-২০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে।

এদিকে, ব্যাংকগুলোর চাহিদা মেটাতে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আজ রোববারও ২ কোটি (২০ মিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এরপরও দর বাড়ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের রোববার পর্যন্ত (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে রোববার পর্যন্ত) সব মিলিয়ে ২৫০ কোটি (২.৫ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে যে দরে ডলার বিক্রি বা কেনে তাকে আন্তব্যাংক লেনদেন ব্যাংক রেট বলে। ব্যাংকগুলোও একে অন্যের কাছ থেকে এই রেটে ডলার কেনাবেচা করে থাকে। চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলো এই দরের চেয়ে সাড়ে চার-পাঁচ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই ব্যবধান কখনই এক থেকে-দেড় টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকায় অস্বাভাবিক দাম বাড়ার শঙ্কা নেই। রিজার্ভে পর্যাপ্ত ডলার জমা আছে। প্রয়োজনমতো সেখান থেকে ডলার বাজারে ছাড়া হবে।

এর আগে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাজার থেকে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়। এরপর থেকেই ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রয়োজনীয় ডলার বাজারে সরবরাহ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে দেশের আমদানি বিল পরিশোধ করে। গত বছরের সর্বশেষ প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়েছে নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে। আকুর বিল পরিশোধ শেষে ৫ জানুয়ারি তা দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এতেই ডলারের ওপর চাপ বেড়েছে। রোববার দিনের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।

আন্তর্জাতিক মানদ-অনুযায়ী, কোনো দেশকে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে হয়। তবে বর্তমানে রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ ছয় মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, সবশেষ গত নভেম্বর মাসে ৭৮৫ কোটি ৪৬ লাখ (৭.৮৫ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। যা এক মাসের হিসাবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেশি।

রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের ছয় মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, এই ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১০ দশমিক ২৩ বিলিয়ন রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ শতাংশ কম।

তবে রপ্তানি বাণিজ্যে বেশ উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। এই ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ২৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.