করোনার দুর্যোগেও পরিচালন মুনাফা বেড়েছে অধিকাংশ ব্যাংকের  

মহামারি করোনার প্রভাবের পাশাপাশি ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ থাকলেও অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। অর্থাৎ করোনার প্রভাব কাটিয়ে দেশের ব্যাংক খাত বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে নীতি সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড় অন্যতম ভূমিকা রেখেছে।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সদ্য বিদায়ী ২০২১ সাল শেষে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। তবে সাময়িক পরিচালন মুনাফা বাড়লেও ভবিষ্যতে তা ব্যাংকের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে এই পরিচালন মুনাফা।

বরাবরের মতোই এবারো দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি সদ্য বিদায়ী বছরে ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে, যা ২০২০ সাল শেষে ছিল ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এক বছরে মুনাফা ৮০ কোটি টাকা বেড়েছে।

ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, পরিচালন মুনাফার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল, এক্সিম, এনসিসি, ঢাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, প্রিমিয়ার, শাহজালাল ইসলামী, যমুনা, এসআইবিএল ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো এখনো পর্যন্ত নিজেদের বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি। এজন্য এ ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার চিত্র জানা সম্ভব হয়নি।

ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড়ের কারণে বেশকিছু ব্যাংকে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে। পরিচালন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনার সুফলও পেয়েছে ব্যাংকগুলো। আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্সের কমিশন থেকে প্রাপ্ত আয় ও পুঁজিবাজার থেকে পাওয়া মুনাফার প্রভাব বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রতিফলিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন অর্থসূচককে বলেছেন, ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে, এটা ঠিক নয়। কেননা ২০২১ সালে দেশে করোনার ভয়াবহতা বিরাজ করেছে। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তায় বেশকিছু ছাড় দিয়েছে। ২০২০ সালে পরিশোধ না করলেও কোন ঋণই খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে ২৫ শতাংশ পরিশোধে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয়া হয়। এসব ছাড়ের ফলে অধিকাংশ ব্যাংকই প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করেনি। এর ফলে আগামীবছরে এসব ব্যাংক ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের জন্য বড় বিষয় নয়। এখন সময় হলো সম্পদের গুণগত মান ঠিক রেখে মূলধনের ভিত শক্তিশালী রাখা। ব্যাংক কখনই স্বল্পমেয়াদি কোনো ব্যবসা নয়। গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রেখে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকাই যে কোনো ব্যাংকের বড় সফলতা।

আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এ মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ ও কর-পরবর্তী মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা। গত ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোর সদ্য বিদায়ী বছরের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব শেষ হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে পূবালী ব্যাংক মুনাফা করেছে ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৯৩৫ কোটি টাকা। মুনাফা ২০৫ কোটি টাকা বেড়েছে।

ইস্টার্ন ব্যাংক বিদায়ী বছরে মুনাফা করেছে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৮৭০ কোটি টাকা। বছরের ব্যবধানে ১৮০ কোটি টাকা মুনাফা বেড়েছে।

এক্সিম ব্যাংক মুনাফা করেছে ৭৮০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৭৪১ কোটি টাকা। মুনাফা ৩৯ কোটি টাকা বেড়েছে।

আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক মুনাফা করেছে ৭৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৬৮০ কোটি টাকা। বছর শেষে মুনাফা ৭০ কোটি টাকা বেড়েছে।

যমুনা ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৬৩৭ কোটি টাকা। মুনাফা ১১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক মুনাফা করেছে ৭১৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৪৮১ কোটি টাকা। ২৩৬ কোটি  টাকা মুনাফা বেড়েছে।

এনআরবিসি ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৩২৩ কোটি টাকা।

সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক মুনাফা করেছে ২১০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ১৫২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ৫৮ কোটি টাকা।

মিডল্যান্ড ব্যাংক মুনাফা করেছে ১৬২ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ১২৫ কোটি টাকা। বছরের ব্যবধানে মুনাফা ৩৭ কোটি টাকা বেড়েছে।

মেঘনা ব্যাংক মুনাফা করেছে ১০৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৭৩ কোটি টাকা। মুনাফা ৩২ কোটি টাকা বেড়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংক মুনাফা করেছে ৩৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৩১৭ কোটি টাকা। ৫৮ কোটি টাকা মুনাফা বেড়েছে।

এনসিসি ব্যাংক মুনাফা করেছে ৭১৭ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৫৭৩ কোটি টাকা। ১৪৪ কোটি টাকা মুনাফা বেড়েছে।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.