সার্জেন্ট মহুয়ার বাবাকে দায়ী করে জিডি

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের বাবা মনোরঞ্জন হাজংয়ের বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। বনানী থানায় গত ১৪ ডিসেম্বর জিডিটি করেছেন মনোরঞ্জনকে চাপা দেওয়া বিএমডব্লিউ গাড়ির চালক সাঈদ হাসান।

গত ২ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় সড়কে দ্রুতগতির বিএমডব্লিউ গাড়ির চাপায় আহত হন মনোরঞ্জন হাজং। পরে তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে শ্যামলীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেওয়া হয়। গুরুতর অবস্থার কারণে অস্ত্রোপচার করে তাঁর ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এরপর তাঁকে শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

ঘটনার পর থেকে মহুয়া হাজং বনানী থানায় একাধিকবার মামলা করার জন্য গেলেও পুলিশ মামলা নিতে রাজি হয়নি। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে মানুষ। পরে বাধ্য হয়ে ঘটনার ১৪ দিন পর গত ১৬ ডিসেম্বর মামলা নেয় বনানী থানা-পুলিশ। মামলায় অজ্ঞাতনামা তিন জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে খবর এল, গাড়িটির চালক ও বিচারপতির ছেলে সাঈদ হাসান গত ১৪ ডিসেম্বর জিডি করেছেন।

জিডিতে দুর্ঘটনার জন্য ভুক্তভোগীকেই পুরো দোষ দেওয়া হয়েছে। এমনকি এ ঘটনায় মনোরঞ্জন হাজংকে আসামি হিসেবে মামলা করা উচিত ছিল বলেও জিডিতে উল্লেখ রয়েছে। দুর্ঘটনার পর পর্যাপ্ত আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে বলেও দাবি করেন সাঈদ হাসান।

বনানী থানায় করা জিডিতে হাসপাতালে ভর্তি থাকার কারণে পুলিশকে ঘটনা জানাতে দেরি হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। জিডির সে কপিতে দেখা যায়, এটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন বনানী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর গাজী। গাড়িচাপায় পা হারানো মনোরঞ্জন হাজং এখন মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সাঈদ হাসান জিডিতে বলেন, ‘আমার গাড়িটি মোটরসাইকেলকে চাপা দেয়নি বা পেছন থেকে ধাক্কা দেয়নি, বরং বেআইনিভাবে উল্টো দিক থেকে মোটরসাইকেলটি ইউলুপে প্রবেশ করে। সে মোটরসাইকেল আরোহী আমার গাড়ির বাঁ-পাশের হেডলাইটে ধাক্কা দেয় এবং এ দুর্ঘটনা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও আমার স্ত্রীর ডানহাতের তিনটি আঙুল ফ্র্যাকচার হয় এবং আমি ঘাড়ে ব্যথা পাই। তাই আমার স্ত্রীকে ৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। তাঁর হাতের প্লাস্টার এখনও খোলা হয়নি। সম্পূর্ণ ঘটনা সড়কের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে রেকর্ড হয়েছে এবং স্থিরচিত্রও আছে। পরে জানতে পারি, সংঘর্ষে লিপ্ত মোটরসাইকেল চালকের নাম মনোরঞ্জন হাজং। তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে ৩ ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে একবার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এরপর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের প্রফেসর রিজভীর অধীনে চিকিৎসার পরামর্শ দিলে ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে আরেকবার পর্যাপ্ত আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন তাঁরা। তবে, পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেয় মনোরঞ্জন হাজংয়ের পরিবার। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে ওইদিন ভোর থেকে একাধিকবার আলাপ করি আমি। পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক নিজে শুক্রবার জুমার পর মনোরঞ্জন হাজংকে দেখতে যান। তাঁরা শুক্রবারেই অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা নেন। পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে অস্ত্রোপচারের পর চরম শয্যা সংকটের মধ্যে মনোরঞ্জন হাজংয়ের জন্য শয্যার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তী সময়ে কেবিন বরাদ্দ করা হয় এবং মেডিকেল বোর্ড ব্যবস্থা করে আমার পক্ষ থেকে চিকিৎসার যাবতীয় বন্দোবস্ত করা হয়।’

জিডিতে সাঈদ হাসান আরও বলেন, ‘সড়কের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যাবে, মনোরঞ্জন হাজং বেআইনিভাবে এবং ট্রাফিক নিষেধ অমান্য করে ইউলুপটির পশ্চিম পাশ থেকে অর্থাৎ উল্টো পথে মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশ করেন। মনোরঞ্জন হাজং জানেন না, উল্টো দিক দিয়ে ইউলুপে প্রবেশ বেআইনি ও নিষিদ্ধ। আমরা এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এ ঘটনা নিয়ে যদি মামলা হয়ে থাকে তাহলে সম্পূর্ণ দায় মনোরঞ্জন হাজংয়ের ওপর বর্তায়। তাঁকে আসামি করেই মামলা করতে হয়। তাই আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি, আমার গাড়িও আটক রাখা হয়নি। গাড়িটি বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পর আমরা ভয় পেয়ে যাই। আমি ও আমার স্ত্রী এই ঘটনার ভুক্তভোগী। কেবল প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কারণে এর দায় আমার নয়। অহেতুক হয়রানি ও অপপ্রচার, মিথ্যা মামলা, মানসিক নির্যাতন, অর্থের জন্য চাপ দেওয়া ইত্যাদি আশঙ্কা থেকে এবং প্রকৃত বিষয় উদ্‌ঘাটনের নিমিত্তে তদন্তপূর্বক বিষয়টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি এ ঘটনার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। এ ছাড়া এ ঘটনায় জিডি বা মামলা করার মনমানসিকতা ছিল না, আমি এখনও শারীরিকভাবে অসুস্থ। ফলে এ বিলম্ব হল।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া বলেন, ‘দুর্ঘটনায় মামলা হয়েছে। জিডি হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। সব খতিয়ে দেখছি। তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আহত মনোরঞ্জন হাজং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার। তাঁর মেয়ে মহুয়া হাজং ট্রাফিক সার্জেন্ট হিসেবে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) কর্মরত। দুর্ঘটনার পর পথচারীরা চাপা দেওয়া সেই বিএমডব্লিউ গাড়ি এবং এর চালকসহ অন্য যাত্রীদের আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও তারা ছাড়া পেয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দুর্ঘটনার সময় বিএমডব্লিউ গাড়িতে চালকের আসনে ছিলেন বিচারপতি রেজাউল হাসানের ছেলে সাঈদ হাসান। তাঁর স্ত্রী অন্তরা সাঈদ আর বন্ধু রোয়াদও গাড়িতে ছিলেন। দুর্ঘটনার পরপরই প্রভাবশালীদের চাপে সাঈদসহ গাড়িটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। একইসঙ্গে তারা মহুয়া হাজংয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আপসের চেষ্টা চালায়। কিন্তু মহুয়া হাজং মামলার বিষয়ে অটল থাকায় এবং গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও বিচারপতির ছেলে বলে আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে ক্ষুব্ধ হন।

পরে, বনানী থানা পুলিশ মহুয়া হাজংয়ের মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করলেও আসামিদের অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি হিসেবে দেখায়। এজাহারে সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮-এর ৯৮ ও ১০৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮-এর ৯৮ ধারায় বেপরোয়া গতি ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর অপরাধে চালকের অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর ১০৫ ধারায় দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বা কেউ মারা গেলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.