বঙ্গবন্ধুর মুক্তির লড়াই এখনো শেষ হয়নি : রেহমান সোবহান

স্বাধীনতা সংগ্রাম  ছিল স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। আর মুক্তির সংগ্রাম ছিল শতবর্ষ ধরে মানুষের ওপর চলা অন্যায় ও অন্যায্যতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে। কিন্তু জাতির সেই স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। দেশের ‍উন্নয়ন হলেও অন্যায্যতা দূর হয়নি।

 

জাতির মুক্তির সংগ্রামে যে মুক্তির কথা বলা হয়েছিল, তা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র—এই চার মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, কিন্তু মুক্তির সেই লড়াই এখনো শেষ হয়নি।

 

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর: অতীতে দৃষ্টিপাত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ (ফিফটি ইয়ারস অব বাংলাদেশ: রেস্ট্রোসপেক্ট অ্যান্ড প্রসপেক্ট) শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রেহমান সোবহান এসব কথা বলেছেন।

 

চার দিনের এই ভার্চ্যুয়াল সম্মেলন  সোমবার (০৬ ডিসেম্বর)  শুরু হয়েছে।

 

মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ সম্পর্কে রেহমান সোবহান মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার দুটি লাইন উল্লেখ করেন, লাইন দুটি হলো, ‘আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।’ অর্থাৎ কাজ শেষ হয়নি, মৃত্যুর আগে আরও বহুদূর যেতে হবে।

 

রেহমান সোবহান বলেন, স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সেটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, পাশাপাশি সামাজিক নানা সূচকে। বাংলাদেশে বিশাল উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে। গ্রামের সাধারণ কৃষকেরা কৃষি উৎপাদ বিপুলভাবে বাড়িয়েছেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা বিরাট ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বিদেশে গেছেন। গান, কবিতা, শিল্পকলা, নাটক—এসব ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এগিয়েছে, যা ধর্মনিরপেক্ষতাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে।

 

রেহমান সোবহানের চোখে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায়। দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ অভিজাত শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে। বড় উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হলেও শিল্প সম্পর্ক হয়ে পড়েছে শোষণের হাতিয়ার। মানুষ রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছে।

 

‘ন্যায্যতাভিত্তিক’ সমাজ নিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অনেকের নানা রকম ব্যাখ্যা আছে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান এ বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘অন্যায্যতা’র উৎস দুটি। প্রথমত, অন্যায্য সরকারের ব্যর্থতার মাধ্যমে তৈরি হওয়া অন্যায্যতা। দ্বিতীয়ত, সমাজে তৈরি হওয়া কাঠামোগত অন্যায্যতা। অন্যায্য সরকার ঘোষিত নীতি, আইন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সমানভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিসরে সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় কাঠামোগত অন্যায্যতা তৈরি হচ্ছে।

 

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল নিবন্ধ উপস্থাপক ছিলেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তাঁর নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন: যেসব অঙ্গীকার পূরণ হয়েছে, যা পূরণ করতে হবে’। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ভাষণের উপসংহারে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘ভিশন’ (রূপকল্প) তুলে ধরেন এই বলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতা ও মুক্তির মধ্যে পার্থক্য কী, তা বঙ্গবন্ধুর কাছে সম্ভবত পরিষ্কার ছিল।

 

রেহমান সোবহান বলেন, বাংলাদেশে সরকারের উচিত বিদ্যমান আইন ও নীতি সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করা। আইনের শাসন নিশ্চিত করা। যদিও কাঠামোগত অন্যায্যতা দূর করা বেশি চ্যালেঞ্জিং। এর জন্য দরকার নতুন নীতি ও আইন এবং আরও শক্তিশালী রাজনৈতিক সংহতি।

 

এ পর্যায়ে রেহমান সোবহান কিছু বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন, যা ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি—গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সুশাসন, শিক্ষার বৈষম্য দূর করা ও পরিবেশ সুরক্ষা। তিনি বলেন, সরকার যদি চায় আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করবে, সে লক্ষ্যে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করে, তাহলেও প্রশ্নহীন নির্বাচন সম্ভব না-ও হতে পারে। কারণ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিনের দিন পক্ষপাতী বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে।

 

 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে অধিবেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক রওনক জাহান সম্মেলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের উন্নতির আংশিক গল্প বলতে চাই না। আমরা যদি শুধু উন্নয়নের কথা বলি, তাহলে আমাদের দৃষ্টি সংকীর্ণ হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু উন্নয়ন ছিল না।’ তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে গর্ব করা ও উদ্‌যাপন করা দরকার। কিন্তু কী কী ঘাটতি আছে ও কী কী ভুল হয়েছে, তা নিয়েও আলোচনা হতে হবে, যাতে শিক্ষা নেওয়া যায়।

 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কর্নেল ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক ইফতিখার হাদি ও সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বক্তব্য দেন।

 

দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন ছিল রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে। এতে বক্তব্য দেন বিআইজিডির গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিটিক্সের প্রধান মির্জা এম হাসান, আমেরিকান ইউনিভার্সিটির নওমি হাসান, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজ প্রমুখ।

 

এছাড়া, চার দিনের এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের ৪৭ জন অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্লেষক অংশ নেবেন। ২০টি উপস্থাপনা ও গবেষণাপত্র তুলে ধরা হবে। অধিবেশন থাকবে মোট আটটি।

অর্থসূচক/ এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.