তামাক কোম্পানির সিএসআর বন্ধ করতে হবে

তামাক কোম্পানির অব্যাহত হস্তক্ষেপে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক, ২০২১’ এ বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্কোর ৭২। গতবছর এই স্কোর ছিল ৬৮। কোভিড-১৯ মহামারিতে কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী কার্যক্রমে হুমকির মুখেপড়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওর্য়াক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এর কার্যকর বাস্তবায়ন এবং তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য।

রবিবার (২৮ নভেম্বর) ঢাকায় প্রকাশিত ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক:এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ২০২১’ গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গবেষণা ওঅ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ও অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, “কোভিডের চেয়ে তামাকের কারণে বাংলাদেশে অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আসলে সরকারি সংস্থাগুলো এফসিটিসি এবং প্রধানমন্ত্রীর

ঘোষণাকে ধারণ করছে কিনা সেটাই মৌলিক প্রশ্ন।” অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, “হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, সেটা কেন?” তিনি বিএটিবি’র শেয়ার প্রত্যাহার এবং তামাকের ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক পুনর্বহালের দাবি জানান।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং টিভি টুডে’র এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, “সরকারি সংস্থাগুলোকে সচেতন করতে হবে যাতে তারা তামাক কোম্পানি থেকে কোন প্রকার সহায়তা গ্রহণ না করে। তামাক কোম্পানির সহায়তা গ্রহণ এফসিটিসি’র সুস্পষ্ট লংঘন এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সাথে সাংঘর্ষিক।”

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বেড়েছে এবং আর্টিক্যাল ৫.৩ এর নির্দেশনাবলী বাস্তবায়নে কোন অগ্রগতি হয়নি। আবারো কূটনৈতিক মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ এবং প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার বিষয়টি উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে।

জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) কোম্পানির পক্ষে অর্থমন্ত্রীকে লেখা জাপানি রাষ্ট্রদূতের চিঠিতে বলা হয়েছে, জেটিআই-এর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোন তামাকনিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ নেয়া হলে তা বাংলাদেশে ভবিষ্যত জাপানি বিনিয়োগের (এফডিআই) পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে।

অন্যদিকে, প্রতিবেদনে উঠে আসা জনস্বাস্থ্যবিরোধী আরেকটি ঘটনার সূচনা করোনা মহামারির শুরুর দিকে। ২০২০ এর এপ্রিলে লকডাউন চলাকালীন সরকারি আদেশের মাধ্যমে দুইটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানির ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) এবং জেটিআই’কে লকডাউনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি প্রদান করে শিল্প মন্ত্রণালয়। কোম্পানিগুলো যাতে নির্বিঘ্নে সিগারেট উৎপাদন, বিপণন ও তামাক পাতা ক্রয় করতে পারে, সেজন্য সকল বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি প্রদান করা হয়। তামাক কোম্পানিকে দেয়া এই বিশেষ অনুমতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তুলে নেয়ার অনুরোধ করা হলে শিল্প মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দেয়।

এশিয়ান টোব্যাকো লিমিটেড নামে একটি তামাক কোম্পানিকে ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। ফলে কর অবকাশসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করবে তামাক কোম্পানিটি। এছাড়া বিড়ির ওপর কর কমানোর দাবি সমর্থন করে দশ জন সংসদ সদস্য অর্থমন্ত্রী বরাবর আধা-সরকারি পত্র প্রেরণ করেন।

গবেষণায়, ২০২০ সালে করোনা মহামারি চলাকালে তামাক কোম্পানিগুলোকে যেভাবে বিভিন্ন কথিত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে, ইতোপূর্বে সেভাবে কখনো দেখা যায়নি। মহামারিসৃষ্ট সংকটের সুযোগ নিয়ে দাতব্য কাজের নামে যেমন আগ্রাসিভাবে ব্র্যান্ড ইমেজ বৃদ্ধি করেছে, অন্যদিকে সুরক্ষা সরঞ্জাম বিতরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রভাবশালী সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সান্নিধ্যে এসে ভবিষ্যত হস্তক্ষেপের পথ সুগম করেছে তামাক কোম্পানিগুলো।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকেও তামাক কোম্পানিগুলোকে পুরস্কৃত করতে দেখা গেছে।

গবেষণার সুপারিশে তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধসহ তামাকনিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে এফসিটিসি’র সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রতি জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি সিগারেটকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিতে ১৯৫৬ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, একটি সহজ তামাককর ও মূল্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার/বিনিয়োগ প্রত্যাহার, তামাক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ বা আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ এর আলোকে আচরণবিধি চূড়ান্তকরণ এবং তামাক কোম্পানিকে সব ধরনের পুরস্কার প্রদান বন্ধসহ প্রদত্ত সকল সুবিধা প্রত্যাহার ও তামাক ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ এর আলোকে একটি নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ২০১৮ সাল থেকে এই গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করে আসছে।

এবছর বিশ্বের ৮০টি দেশে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের বৈশ্বিক সূচকে ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৬২তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ এবারও সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় সরকার তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপসমূহ কিভাবে আমলে নেয় এবং সেগুলো মোকাবিলায় কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ গাইডলাইনের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সূচকে স্কোর যত বেশি, হস্তক্ষেপ তত বেশি।

ব্লুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিস এর স্টপ (স্টপিং টোব্যাকো অরগানাইজেশন্স অ্যান্ড প্রোডাক্টস) প্রজেক্ট এর আওতায় এই গবেষণায় সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছে গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি), থামাসাত ইউনিভার্সিটি থাইল্যান্ড।

অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন ড. মেরি আসুন্তা, হেড অব গ্লোবাল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি, জিজিটিসি; মো. শফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ কান্ট্রি অ্যাডভাইজার, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস; মুহাম্মদ রূহুল কুদ্দুস, বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই); মো. মোস্তাফিজুর রহমান, লিড পলিসি অ্যাডভাইজর, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে), বাংলাদেশ; ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক, ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা; সৈয়দ মাহবুবুল আলম, টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, দি ইউনিয়ন; এবং এবিএম জুবায়ের, নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা। আত্মা’র কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।

গবেষণা ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল, তামাকবিরোধী সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রজ্ঞা’র তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কর্মসূচি প্রধান মো: হাসান শাহরিয়ার।

অর্থসূচক/আরএমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.