রাজারবাগের পীরের বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে, আপিল খারিজ

রাজারবাগ পীরের সিন্ডিকেট নিয়ে দুদক, সিআইডি ও সিটিটিসিকে তদন্ত করতে বলা হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে করা আপিল খারিজ হয়ে গেছে। ফলে বহাল থাকলো পীর সিন্ডিকেট নিয়ে দেওয়া হাইকোর্টের আদেশ।

মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেত্বত্বাধীন বেঞ্চ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে করা পীর দিল্লুরের আবেদন বাতিল করে এ আদেশ দেন।

পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিমতের ভিত্তিতে পীর ও অনুসারীদের জঙ্গি সম্পৃক্ততা আছে কি না, সে বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে তদন্ত করতে নির্দেশসহ কয়েক দফা নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া পৃথক মামলা দিয়ে রিট আবেদনকারীদের হয়রানির যে অভিযোগ, তা তদন্ত করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদন্ত করে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন বিবেচনায় তদন্তকাজে তিনটি সংস্থা পদক্ষেপ নেবে বলে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট। রিট আবেদনকারীদের অযথা হয়রানি না করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।

একইসঙ্গে আবেদনকারীদের মামলা প্রতারণামূলক কি না, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুটি তদন্তই ৬০ দিনের মধ্যে শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এ মামলার শুনানি থেকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নিজেকে বাদ রাখেন। আপিল বিভাগে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না অপরদিকে পীরের পক্ষে ছিলেন এম কে রহমান।

এর আগে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে করা আবেদন গত ১১ অক্টোবর চেম্বার আদালত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত না করে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেন। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে গত ১৯ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট রুল দিয়ে রাজারবাগ দরবার শরিফ ও দরবারের পীর দিল্লুর রহমানের সম্পদ ও দায় বিষয়ে তদন্ত করতে দুদককে নির্দেশ দেন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

পীর দিল্লুর রহমানের ‘অনুসারীদের’ করা মানবপাচারসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় হয়রানির শিকার আট ভুক্তভোগীর এই রিট আবেদনটি করেন। রিটকারীরা হলেন মো. আব্দুল কাদের, মাহবুবুর রহমান খোকন, ফজলুল করিম, জয়নাল আবেদিন, মো. আলাউদ্দিন, জিন্নাত আলী, আইয়ুবুর হাসান শামীম ও নারগিস আক্তার।

এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শান্তিবাগের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৯টি মামলার নেপথ্যে এক পীর সাহেব ও তাঁর অনুসারীরা রয়েছে বলে হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদনে জানিয়েছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই প্রতিবেদন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলছেন, ‘বাংলাদেশের পীর সাহেবের কাণ্ড দেখুন।’ পরে প্রতিবেদনের ওপর আদেশের জন্য ১৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছিলেন আদালত।

সিআইডির এই প্রতিবেদন দেখে হাইকোর্ট বলেন, ‘বাংলাদেশের পীর সাহেবের কাণ্ড দেখুন! জায়গা জমি দখলের জন্য পীর সাহেবরা অনুসারী-মুরিদ দিয়ে কী করে দেখুন! যেখানে একজন মানুষকে একটা মামলা দিলেই জীবন শেষ হয়ে যায়, সেখানে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এত মামলা! এটা তো সিরিয়াস ব্যাপার।’

হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘একরামুল আহসান কাঞ্চনেরা তিন ভাই এবং এক বোন। ১৯৯৫ সালে তাঁদের বাবা ডা. আনোয়ারুল্লাহ মারা যান। রাজারবাগ দরবার শরিফের পেছনে তিন শতাংশ জমির ওপর তিনতলা বাড়ি কাঞ্চনদের। বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তার-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর সাহেব দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন।’

তবে, রিট আবেদনকারী ও তার অপর ভাই ডা. কামরুল আহসান বাদল ওই পীর সাহেবের মুরিদ হননি। এরই মধ্যে একরামুল আহসান কাঞ্চনের মা, ভাই ও বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির অধিকাংশই দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়। আর, একরামুল আহসান কাঞ্চন ও তাঁর ভাইয়ের অংশটুকু হস্তান্তর করার জন্য পীর সাহেব দিল্লুর রহমান এবং তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেন। কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় দিল্লুর রহমান ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে একরামুল আহসান কাঞ্চনের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। সে কারণেই একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় হয়রানিমূলক মামলা করা হয়।

সিআইডির এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় সর্বমোট ৪৯টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে জিআর মামলা ২৩টি এবং সিআর মামলা ২৬টি। এরই মধ্যে জিআর ১৫টি মামলা এবং সিআর ২০টি মামলায় আবেদনকারী আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন। যার মধ্যে আটটি জিআর এবং ছয়টি সিআর মামলা রয়েছে। অধিকাংশ মামলার নথিপত্র সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, হত্যার চেষ্টা মামলাসহ প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন ধর্তব্য ও অধর্তব্য ধারায় মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলো সম্পর্কে প্রকাশ্য ও গোপনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী, ভুক্তভোগীরা কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ এবং পীর সাহেবের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’

এর আগে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৯টি মামলা হওয়ার প্রেক্ষাপটে একরামুল আহসান কাঞ্চন ন্যায়বিচার পেতে এবং এ ঘটনার পেছনে কারা তা তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। সেই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট সিআইডিকে একরামুলের বিরুদ্ধে হওয়া ৪৯টি মামলার তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে রুলসহ আদেশ দেন। এরপর মামলাকারীদের কয়েকজন হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.