দেশে ফেরার কথা ভুলে গেছে রোহিঙ্গারা

চার বছর আগে ২৫ আগস্টের এদিনে বাংলাদেশে ঢল নেমেছিল রোহিঙ্গাদের। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছিলেন রোহিঙ্গারা। সেই ঘটনার চার বছরে দীর্ঘ বৈঠক আর আলোচনা হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তার সঙ্গে আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গাসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে বসবাস করছে। কখন তারা স্বদেশে ফিরে যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা নানা কারণে থমকে আছে।

বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হয়ে আসে। এসময় মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দোহাই দিয়ে আসা প্রায় সাড়ে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও বান্দরবন জেলায় আশ্রয় নেয়। ওই সময়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় বা ভরণপোষণে আন্তর্জাতিক কোন সাহায্য সহযোগিতা ছিল না। পরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতে মিয়ানমার সরকার দুই লাখ রেহিঙ্গাকে ফেরত নেয়। ওই সময়ে থেকে যাওয়া প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা পরবর্তীতে বিভিন্ন উপায়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে নাগরিকত্ব নিয়ে নেয়।

১৯৯২ সালে মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতায় রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালালে সে বছর আড়াই লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়। ২০১২ সাল ও ২০১৬ সালেও বাংলাদেশে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখের বেশি। ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে ঢুকেছিল সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা।

সবমিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখের অধিক। সেখানে সাড়ে এগার লাখ রোহিঙ্গার বসবাস উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে। বাকিরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে ক্যাম্পের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়ে নিজেদের বাঙালি ও বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয় দিচ্ছেন।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কবে দেশে ফেরত পাঠানো হবে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা। দুই দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার পর এখন আর রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর কোন উদ্যোগই নেই। এরই মাঝে রোহিঙ্গারাও স্বদেশে ফেরার কথা অনেকটা ভুলে গেছেন। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশেই থেকে যেতে চায়। কেউকেউ আবার শর্ত মানলে মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি। তবে মিয়ানমার ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের প্রধান শর্ত তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দেওয়া।

টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী ছমুদা বেগম বলেন, মিয়ানমার ফিরে গেলে আমাদের কষ্টে দিনযাপন করতে হবে। সেখানে আমাদের আয় রোজগারের সুযোগ থাকবে না। এখানে আমরা ঘরে বসে খাবার, চিকিৎসা সবই পাচ্ছি। আমাদের এই আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে কেন আবার মিয়ানমার ফেরত পাঠানোর কথা উঠছে বুঝছি না।

উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুবক আলী আহমদ বলেন, মিয়ানমার সরকার সহজে আমাদের মেনে নেবে না। আমাদের নাগরিকত্ব ও ভিটেমাটি ফেরত দেবে না। সেখানে আবারো আমাদের শরণার্থী হয়ে পাঠানো আমাদের জন্য হুমকি হবে।

একই উপজেলার কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ আলম বলেন, মিয়ানমার সরকার এখনো রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। প্রত্যাবাসনের নামে আমাদের আবারো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিলে সেটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য হতাশাজনক হবে।

উখিয়া ও টেকনাফের দুই উপজেলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ রোহিঙ্গা স্বদেশে ফেরত যেতে অনাগ্রহী। তাদের কেউ কেউ মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে এ কথা যেন ভুলেই গেছেন। তাদের ভরসা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রাখতে সাধ্যমতে চেষ্টা করবে এবং তাদের পাশে থাকবে। তবে এত বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় এমন রোহিঙ্গারও দেখা মিলে কোন কোন ক্যাম্পে। কিন্তু বেশির ভাগ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ফেরার বিরোধী হওয়ায় যারা ফিরতে আগ্রহী তারা মুখ খুলতে পারে না অন্যদের ভয়ে।

উখিয়ার থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বয়োবৃদ্ধ রোহিঙ্গা আজম উল্লাহ বলেন, আমার জন্মস্থান মিয়ানমার, বাপ দাদার কবর সেখানে। শরণার্থী জীবন আর ভালো লাগছে না। নিজ দেশে ফিরতে মন চাইছে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটা জন্মভূমিতে ত্যাগ করতে চাই, সেখানে মরতে চাই। যত দ্রুত ফিরতে পারি ততই আমাদের জন্য এবং রোাহিঙ্গা জনগোষ্টির জন্য কল্যানজনক। সেটি অনেক রোহিঙ্গা বুঝে না।

এদিকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত পাঠানোর কোন তড়িৎ উদ্যোগ না থাকায় বাংলাদেশিদের মধ্যে দিনদিন ক্ষোভ ও চরম অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। তাদের মতে রোহিঙ্গাদের বসবাসের কারণে বিশেষ করে কক্সবাজারে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। রোহিঙ্গারা দিনদিন সহিংস, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, ধর্ষণ, মাদক পাচার থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই যা রোহিঙ্গারা করছেন না।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয় জানায়, প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মিয়ানমারের কাছে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ ধাপে মোট ৫ লাখ ৯৭ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সে-বছরের শুরুতে একসঙ্গে ৪ লাখ ৯২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়েছে। এসব তালিকা থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১১ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু তাও এখন পর্যন্ত ফেরত নেয়নি।

রোহিঙ্গাদের ফেরতের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। তবে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। এছাড়াও বিভিন্ন রাষ্ট্র মুখে মুখে মানবাধিকারের কথা বললেও মিয়ানমারের সঙ্গে ঠিকই ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ ড. মোমেন।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করছে। তাদেরকে একসময় তাদের দেশে ফেরত যেতে হবে। রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এখন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার অপেক্ষা।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.