‘দামে কম, মানে ভালো!’

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানের মামুলি ও আপাত হাস্যকর শ্লোগান ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়ে উঠে। শ্লোগানটি হচ্ছে-‘দামে কম, মানে ভালো, কাকলি ফার্নিচার। শ্লোগানটি এতই জনপ্রিয় হয় যে, এর ঢেও বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবাংলাতেও সাড়া ফেলে তা।

কাকলি ফার্নিচারের এই শ্লোগানের ঢেও যেন আমাদের পুঁজিবাজারেও লেগেছে। বিশেষ করে গত কিছুদিনের বাজার-আচরণে (Market Behaviour) এমনটিই মনে হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ শেয়ারের মৌলভিত্তি পর্যালোচনা না করে শুধু মূল্যকে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে নিয়ে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যেসব কোম্পানির পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার কোনো বালাই নেই, গত কয়েক বছরে লভ্যাংশ দেয়নি, উৎপাদন বন্ধ ছিল-এমন সব কোম্পানির শেয়ারও এখন লেনদেনের শীর্ষে উঠে আসছে। বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারী ঝাঁপিয়ে পড়ায় এসব শেয়ারের দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

বাজার-মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে কয়েকটি ব্রোকারহাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছিলাম। এদের বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বিনিয়োগকারীদের একাংশ মনে করছে, যেসব শেয়ারের দাম তুলনামূলক কম, সেগুলোর দাম বৃদ্ধির ‘জায়গা আছে’। আর মূল্য কমলেও অন্য শেয়ারের তুলনায় ‘কম কমছে’ বলে ঝুঁকিও কম। যদিও বিনিয়োগকারীদের এই মূল্যায়ন বা পর্যবেক্ষণকে যথাযথ মনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।

শেয়ারের দাম কম আছে বলেই সেগুলোর মূল্য বৃদ্ধির জায়গা আছে, সেটি একটি ভুল চিন্তা। কারণ শেয়ারের দাম হচ্ছে আপেক্ষিক। এটি কম বলেই বাড়বে, তেমন নয়। বরং কোম্পানির মৌলভিত্তি সমর্থন করলে (ব্যবসার ধারাবাহিকতা, ইপিএস, লভ্যাংশ, মূল্য-আয় অনুপাত ইত্যাদি) ‘বেশি দাম’ এর শেয়ারেরও দাম বাড়তে পারে। আর কোম্পানির মুনাফা ভাল না হলে, লভ্যাংশ না দিলে শেয়ারের দাম কম হলেও সেটি অনিরাপদ।

এছাড়া এসব বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্বে আরও একটি ভুল বিষয় কাজ করছে বলে মনে হয়। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের মূল্য পরিবর্তনকে শতকরা হিসেবের পরিবর্তে সংখ্যার হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত বলে কম দামি শেয়ারের দাম কমলেও তাদের কাছে সেটি কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। ধরা যাক, এবিসি কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৮০ টাকা। সেটির দাম আজ ৪ টাকা কমেছে। অন্যদিকে এক্সওয়াইজেড কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ২০ টাকা। সেটির দাম আজ ২ টাকা কমেছে। আপাতদৃষ্টিতে এক্স‌ওয়াইজেড কোম্পানির শেয়ারের দাম কম কমেছে বলে মনে হচ্ছে, যদিও বাস্তব অবস্থা ঠিক উল্টো। কারণ এবিসি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে মাত্র ৫ শতাংশ, যেখানে এক্সওয়াইজেড কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ কমেছে।

কারণ যেটিই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ যেহেতু মনে করছে, ‘কমদামি’ শেয়ারগুলোর মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ বেশি, তাই তারা এসব শেয়ারেই বেশি ঝুঁকছে। আর ভুল-শুদ্ধ যে হিসাবই হোক, যখন একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগকারী কিছু বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করতে শুরু করে, তখন ওই শেয়ারের চাহিদা বেড়ে যায়। তাতে শেয়ারের মূল্যও বাড়ে।

তবে কম দামের তথা দূর্বল মৌলের এসব শেয়ারের প্রতি যে শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হুমরি খেয়ে পড়েছেন তা নয়, বড় মূলধনধারী ব্যক্তি বিনিয়োগকারী (High networth Individual), এমনকি কথিত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণও এসব শেয়ারে বাড়ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বেশ কিছু দূর্বল মৌলের শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশ গত কয়েক মাসে বেড়েছে। হয়তো এসব প্রতিষ্ঠান ও বড় ব্যক্তি বিনিয়োগকারীই নিজেদের গেম প্ল্যানের অংশ হিসেবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাথায় বিষয়টি ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে, কম দামের শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগের ঝুঁকি কম এবং এগুলোর মূল্য বৃদ্ধির যথেষ্ট জায়গা আছে।

তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে রাখতে হবে, বাজার সব সময় একরকম যায় না। অতি তেজি বা বাবলময় বাজারে যে তত্ত্বকে বাস্তবসম্মত মনে হয়, বাজারে ধস নামলে বা বড় মূল্য সংশোধন হলে কিন্তু সেটি-ই অসাড় প্রমাণিত হয়। ২০১০ সালের তেজি বাজারে ‘এম’ অক্ষরের একটি টেক্সটাইল কোম্পানির শেয়ারের দাম উঠেছিল ১৮০ টাকা। সেটি কিন্তু পরবর্তীতে ১৩ টাকাতেও নেমেছিল। বাজারে ধসের পর যে কোম্পানির পারফরম্যান্সেও ধস নামে। কোম্পানিটি কয়েক বছর লভ্যাংশ দেয়নি বিনিয়োগকারীদের। ব্যবসায় লোকসান দেখিয়েছে বছরের পর বছর। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে আমাদের বাজারে।

মনে রাখা দরকার, বড় ব্যক্তি-বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চেয়ে অনেক বেশি চৌকষ (Smart)| তাছাড়া এরা গেম-প্ল্যানের নেপথ্যে থাকেন বলে জানেন কখন শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যেতে হয়। একবার তারা বের হয়ে গেলে ওই শেয়ারের দাম আর আগের জায়গায় থাকার কোনো সুযোগ থাকে না। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে মূল্য কমতে থাকে, আর তারা ভাবতে থাকেন বাড়লে তারা এই শেয়ার বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু সেই প্রত্যাশিত সময়ের দেখা আর মেলে না।

তাছাড়া বড় ব্যক্তি বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তহবিল অনেক বড় এবং শেয়ার ধারণ করার সক্ষমতাও অনেক বেশি। তাই কোনো কারণে একটি শেয়ারে তারা আটকে গেলে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে পারেন সুসময়ের জন্য। প্রয়োজনে দাম অনেক কমে গেলে ওই শেয়ার আরও বেশি পরিমাণে কিনে শেয়ারের গড় ক্রয় মূল্য (Costing) অনেক কমিয়ে নিয়ে আসতে পারেন, যাতে আবার কখনো দাম অল্প বাড়লেই তারা ওই শেয়ার বেচে লোকসান থেকে বের হয়ে আসতে পারেন। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে যাদের মূলধন কম, তাদের এই সুযোগ থাকে না। তাই আবার অনুকূল অবস্থা আসার আগেই তাদেরকে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হয়। তাতে লোকসান অনিবার্য হয়ে উঠে।

তাই অন্যদের দেখাদেখি বা কান কথায় হুজুগে মেতে শেয়ার না কিনে, নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার আলোকে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কোনো শেয়ার কেনার পর বড় মূল্য সংশোধন হলে যেন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা যায়, আর ওই অপেক্ষাকালীন সময়ে ভাল লভ্যাংশ পাওয়া যায, এসব বিষয়ও বিবেচনায় রাখা দরকার।

# জিয়াউর রহমান, সম্পাদক, অর্থসূচক।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.